০২:০০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
আড়াই মাস ধরে উৎপাদন বন্ধ, প্রতিদিন ক্ষতি ১০ লাখ টাকা

১৫ হাজার চা শ্রমিকের মানবেতর জীবন

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে সিলেটের চা শিল্পে। পাঁচ আগস্টের পর থেকে ন্যাশনাল টি কোম্পানির রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সিলেটের ১২টি বাগানে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এতে প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ১০ লাখ টাকা। কর্মহীন হয়ে পড়েছে অন্তত ১৫ হাজার শ্রমিক। শ্রমিকরা বলছে, বেতন বন্ধ থাকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে চলা দায় হয়ে পড়েছে তাঁদের। আর বাগান কর্তৃপক্ষ বলছে, শ্রমিকদের বেতন দ্রুত পরিশোধে তাঁরা কাজ করছে। শ্রমিকদের দাবি তাদের ১০ সপ্তাহের বেতন বকেয়া আছে। বকেয়া বেতনের দাবিতে কর্মবিরতির পাশাপাশি প্রতিদিনই তাঁরা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন।

এদিকে, শ্রমিকদের টানা কর্মবিরতিতে বন্ধ হয়ে গেছে এসব বাগানের উৎপাদন। এতে করে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে তেমন হুমকির মুখে পড়েছে চা শিল্প। তাই দ্রুতই বেতন পরিশোধ করে সম্ভাবনাময়ী এই শিল্পকে ক্ষতি থেকে রক্ষার দাবি জানিয়েছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।

সরেজমিন সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগানে গেলে কথা হয় শ্রমিক লাভলি দাসের সঙ্গে। তিনি প্রতিবেদককে জানান, দুই কন্যা সন্তান ও স্বামীসহ চার পরিবারের সদস্য তাঁর। স্বামী ও স্ত্রী দুজনেই কাজ করেন লাক্কাতুরা চা বাগানে। গত ১০ সপ্তাহ ধরে বেতন না পাওয়ায় মানবেতর জীবন পার করছেন তিনি। বর্তমানে মানুষের বাড়িতে কাজ করে কোনোরকমে দিন পার করছেন তারা। দুই কন্যা সন্তানের খরচ, পরিবারের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।

জানা গেছে, সারা দেশে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ন্যাশনাল টি কোম্পানির ফাঁড়ি বাগানসহ ১৬টি চা-বাগান রয়েছে। এর মধ্যে সিলেট বিভাগে এনটিসির বাগান রয়েছে ১২টি। এসব বাগানে প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক কাজ করলেও গত দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে তারা মজুরি পাচ্ছেন না। ফলে মানবেতর জীবনযাপন করছেন শ্রমিক ও পরিবারের সদস্যরা। বেতন-ভাতা না পেয়ে গত ১১ অক্টোবর থেকে কর্মবিরতি পালন করছেন শ্রমিকরা। শুধুমাত্র সিলেট জেলাতেই রয়েছে তিনটি চা বাগান। এদের মধ্যে, লাক্কাতুরা চা বাগান, দলদলি চা বাগান ও কেওয়াপাড়া চা বাগান। এই তিনটি বাগানইন ন্যাশনাল টি কোম্পানীর আওতাধীন।

চা শ্রমিক লাভলি দাস আরও বলেন, আমরা অনেকদিন ধরে আন্দোলন করেও বকেয়া মজুরি পাচ্ছি না। এ নিয়ে আমরা খুব সমস্যায় পড়েছি। এমনকি কাউকেই পাশে পাচ্ছি না। কোনো মহলই আমাদের বেতন কবে পাবো এই বিষয়েও কোনো নিশ্চয়তা দিচ্ছে না। শুরুতে আমরা বিনা মজুরিতে সাত সাপ্তাহ কাজ করেছি। এরপর বাধ্য হয়ে আন্দোলনে নেমেছি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেটের বাগানগুলো থেকে প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার কেজি তাজা পাতা উত্তোলন করা হয়। এসব চা পাতা থেকে দৈনিক ৫ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়। এই হিসেবে প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ টাকা ক্ষতি হচ্ছে বাগানগুলোর। এতে করে সরকার হারাচ্ছে বিশাল অংকের রাজস্ব। পাশাপাশি হুমকিতে পড়েছে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও।

লাক্কাতুরা চা বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সদস্য নিরেন গোয়ালা জানান, ১০ সপ্তাহের বকেয়া বেতন, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা ১৩ মাস ধরে ভবিষ্যৎ ফান্ডে জমা না হওয়া, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা না পাওয়া ও ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি সংস্কার করে না দেওয়ায় কর্মবিরতি পালন করছে শ্রমিকরা।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেটের সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, শ্রমিকরা বেতন ভাতা না পাওয়ার কারণে আন্দোলন করছেন। বর্তমানে চা উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। ছয় সপ্তাহ কাজ করার সময় মজুরি আজ কাল দিবেন বলে কালক্ষেপণ করেন। বেতন না থাকার কারণে একযোগে সিলেটের ১২টি চা বাগানে আন্দোলনের নামেন শ্রমিকরা। আমরা চাই না এই শিল্পটা অচল হোক। আমরা চাই শিল্পটা চালু থাকুক। শিল্পটা চালু থাকলে সরকারও রাজস্ব পাবে পাশাপাশি শ্রমিকরা বাঁচবে। বর্তমানে বাজারে যে উর্ধ্বগতি এমনিতি ১৭০ টাকা মজুরি দিয়ে চলা মুশকিল তার উপরে যদি মজুরি বন্ধ থাকে তাহলে এটা খুবই কষ্টদায়ক।

এ ব্যাপারে সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগানের ব্যবস্থাপক মো. আক্তার শাহেদ বলেন, ‘কৃষি ব্যাংকের ঋণ জটিলতায় শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধে সমস্যা হচ্ছে। তবে দ্রুত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।’

আড়াই মাস ধরে উৎপাদন বন্ধ, প্রতিদিন ক্ষতি ১০ লাখ টাকা

১৫ হাজার চা শ্রমিকের মানবেতর জীবন

প্রকাশিত: ১২:১০:২৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে সিলেটের চা শিল্পে। পাঁচ আগস্টের পর থেকে ন্যাশনাল টি কোম্পানির রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সিলেটের ১২টি বাগানে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এতে প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ১০ লাখ টাকা। কর্মহীন হয়ে পড়েছে অন্তত ১৫ হাজার শ্রমিক। শ্রমিকরা বলছে, বেতন বন্ধ থাকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে চলা দায় হয়ে পড়েছে তাঁদের। আর বাগান কর্তৃপক্ষ বলছে, শ্রমিকদের বেতন দ্রুত পরিশোধে তাঁরা কাজ করছে। শ্রমিকদের দাবি তাদের ১০ সপ্তাহের বেতন বকেয়া আছে। বকেয়া বেতনের দাবিতে কর্মবিরতির পাশাপাশি প্রতিদিনই তাঁরা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন।

এদিকে, শ্রমিকদের টানা কর্মবিরতিতে বন্ধ হয়ে গেছে এসব বাগানের উৎপাদন। এতে করে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে তেমন হুমকির মুখে পড়েছে চা শিল্প। তাই দ্রুতই বেতন পরিশোধ করে সম্ভাবনাময়ী এই শিল্পকে ক্ষতি থেকে রক্ষার দাবি জানিয়েছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।

সরেজমিন সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগানে গেলে কথা হয় শ্রমিক লাভলি দাসের সঙ্গে। তিনি প্রতিবেদককে জানান, দুই কন্যা সন্তান ও স্বামীসহ চার পরিবারের সদস্য তাঁর। স্বামী ও স্ত্রী দুজনেই কাজ করেন লাক্কাতুরা চা বাগানে। গত ১০ সপ্তাহ ধরে বেতন না পাওয়ায় মানবেতর জীবন পার করছেন তিনি। বর্তমানে মানুষের বাড়িতে কাজ করে কোনোরকমে দিন পার করছেন তারা। দুই কন্যা সন্তানের খরচ, পরিবারের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।

জানা গেছে, সারা দেশে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ন্যাশনাল টি কোম্পানির ফাঁড়ি বাগানসহ ১৬টি চা-বাগান রয়েছে। এর মধ্যে সিলেট বিভাগে এনটিসির বাগান রয়েছে ১২টি। এসব বাগানে প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক কাজ করলেও গত দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে তারা মজুরি পাচ্ছেন না। ফলে মানবেতর জীবনযাপন করছেন শ্রমিক ও পরিবারের সদস্যরা। বেতন-ভাতা না পেয়ে গত ১১ অক্টোবর থেকে কর্মবিরতি পালন করছেন শ্রমিকরা। শুধুমাত্র সিলেট জেলাতেই রয়েছে তিনটি চা বাগান। এদের মধ্যে, লাক্কাতুরা চা বাগান, দলদলি চা বাগান ও কেওয়াপাড়া চা বাগান। এই তিনটি বাগানইন ন্যাশনাল টি কোম্পানীর আওতাধীন।

চা শ্রমিক লাভলি দাস আরও বলেন, আমরা অনেকদিন ধরে আন্দোলন করেও বকেয়া মজুরি পাচ্ছি না। এ নিয়ে আমরা খুব সমস্যায় পড়েছি। এমনকি কাউকেই পাশে পাচ্ছি না। কোনো মহলই আমাদের বেতন কবে পাবো এই বিষয়েও কোনো নিশ্চয়তা দিচ্ছে না। শুরুতে আমরা বিনা মজুরিতে সাত সাপ্তাহ কাজ করেছি। এরপর বাধ্য হয়ে আন্দোলনে নেমেছি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেটের বাগানগুলো থেকে প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার কেজি তাজা পাতা উত্তোলন করা হয়। এসব চা পাতা থেকে দৈনিক ৫ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়। এই হিসেবে প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ টাকা ক্ষতি হচ্ছে বাগানগুলোর। এতে করে সরকার হারাচ্ছে বিশাল অংকের রাজস্ব। পাশাপাশি হুমকিতে পড়েছে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও।

লাক্কাতুরা চা বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সদস্য নিরেন গোয়ালা জানান, ১০ সপ্তাহের বকেয়া বেতন, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা ১৩ মাস ধরে ভবিষ্যৎ ফান্ডে জমা না হওয়া, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা না পাওয়া ও ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি সংস্কার করে না দেওয়ায় কর্মবিরতি পালন করছে শ্রমিকরা।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেটের সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, শ্রমিকরা বেতন ভাতা না পাওয়ার কারণে আন্দোলন করছেন। বর্তমানে চা উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। ছয় সপ্তাহ কাজ করার সময় মজুরি আজ কাল দিবেন বলে কালক্ষেপণ করেন। বেতন না থাকার কারণে একযোগে সিলেটের ১২টি চা বাগানে আন্দোলনের নামেন শ্রমিকরা। আমরা চাই না এই শিল্পটা অচল হোক। আমরা চাই শিল্পটা চালু থাকুক। শিল্পটা চালু থাকলে সরকারও রাজস্ব পাবে পাশাপাশি শ্রমিকরা বাঁচবে। বর্তমানে বাজারে যে উর্ধ্বগতি এমনিতি ১৭০ টাকা মজুরি দিয়ে চলা মুশকিল তার উপরে যদি মজুরি বন্ধ থাকে তাহলে এটা খুবই কষ্টদায়ক।

এ ব্যাপারে সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগানের ব্যবস্থাপক মো. আক্তার শাহেদ বলেন, ‘কৃষি ব্যাংকের ঋণ জটিলতায় শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধে সমস্যা হচ্ছে। তবে দ্রুত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।’