সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩৮ জন কর্মকতা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা দুই বছর ধরে বন্ধ। দীর্ঘদিন ধরে বেতন না পাওয়ায় তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বাসা ভাড়া দিতে ব্যর্থ হয়ে অনেকেই পরিবারের সদস্যদের গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। অনেকে প্রাইভেট পড়িয়ে কোনোমতে টিকে থাকার চেষ্ঠা করছেন। কেউ কেউ ফিরেছেন অন্য পেশায়।
ছয় বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের কাজেও খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। অস্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রমও শুরু করা যায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা প্রহরী মোহাম্মদ মুক্তার আলী (৪৫) জানান, সংসারের খরচ জোগাতে এখন তিনি ভ্যানে করে নগরীতে (ভ্রাম্যমাণ) সবজি বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, ‘নিয়মিত অফিস করছি। কিুন্তু দুই বছর ধরে বেতন-ভাতা পাচ্ছি না। চাকরি আছে না নেই তা-ও বলতে পারছি না। দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবারের খরচ চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। খেয়ে না খেয়ে দিনযাপন করছি, আর কুলোতে পারছি না। তাই বাধ্য হয়ে ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করছি।’
মুক্তার আলীর মতো আরও অনেকেরই একই অবস্থা। তাদেরই একজন আল-আমিন হোসেন (৩২) জানান, ২০১৯ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লিনার পদে তিনি চাকরি করছেন। মুক্তার আলীর মতো তিনিও বেতন-ভাতা উত্তোলন করতে পারছেন না। চার সদস্যের পরিবারকে নিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে দিনযাপন করছেন। দুঃখ দুর্দশার বর্ণনা দিতে গিয়ে অশ্রæসিক্ত আল-আমিন বলেন, ‘অনেক দিন উপবাস করেছি। সন্তানদের তো আর না খাইয়ে রাখতে পারি না। সংসারের খরচ জোগাতে এখন রিকশা চালাই।’
২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লিনার পদে নিয়োগ পান ফৌজিয়া সুলতানা মণি। তারও বেতন-ভাতা বন্ধ রয়েছে। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘বেতন বন্ধ থাকায় বাচ্চা নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করছি। এখন আর চলতে পারছি না।’ বেতন বন্ধ থাকায় পারিবারিক সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে তিনি জানান।’ জীবিকার তাগিদে কর্মচারীদের আরও অনেকে অন্যত্র ডে-লেবার হিসেবে কেউ রিকশা চালাচ্ছেন, কেউবা মুদি দোকানে কাজ করছেন।
জানা গেছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বন্ধ। অফিসে কেউ আসেন, কেউ না। কার চাকরি আছে আর কার নেই; তা-ও জানা নেই। অফিসে না এলেও জবাবদিহির ব্যবস্থা নেই। নেই কোনো প্রোটোকল। ৫ আগস্টের পর থেকে উপাচার্যেরও দেখা পাননি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সবশেষ গত বৃহস্পতিবার কার্যালয়ে ফিরেন উপাচার্য প্রফেসর ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেন। প্রায় আড়াইমাস পর ক্যাম্পাসে ফিরেই বেতন বঞ্চিতদের তোপের মুখে পড়েন তিনি। ভিসি কার্যালয়ে এসেছেন এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে ক্যাম্পাসে জড়ো হন বেতনবঞ্চিতরা। চাকরি নিয়মিতকরণ ও বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে ভিসিকে অবরুদ্ধ করে রাখেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পর ভিসি ১৫ দিনের মধ্যে দাবি দাওয়া পূরণের আশ্বাস দিলে তার অবরুদ্ধ অবস্থার অবসান হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী পরিষদের সভাপতি আব্দুস সামাদ চৌধুরী বলেন, দুই বছর ধরে আমরা বিনা বেতনে কাজ করছি। ৫ আগস্টের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, রেজিস্ট্রার ও কোষাধ্যক্ষ তিনজনই লাপাত্তা ছিলেন। বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করেও দেখা মিলেনি তাঁর। গত বৃহস্পতিবার সকালে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কতিপয় নেতাকর্মীদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে গুরুত্বপূর্ণ নথি নিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে ক্যাম্পাসে অবস্থান নেন তারা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও বিষয়টি সুরাহা করতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে বৈঠকে বসেন ভিসি, ট্রেজারার সেনাবাহিনী ও পুলিশসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পরে ভিসি ১৫ দিনের মধ্যে দাবি দাওয়া পূরণের আশ্বাস দেন।
২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। পরবর্তীতে নাম পাল্টে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি ডা. মুর্শেদ আহমদ চৌধুরী ও রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) নঈমুল হক চৌধুরী নিয়োগ বাণিজ্যসহ ব্যাপক জালিয়াতি করেন। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে মেয়াদ শেষ হলে প্রথমে চাকরি হারান রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) নঈমুল হক চৌধুরী। এরপর একই পথে যেতে হয় ভিসি প্রফেসর ডা. মোর্শেদ আহমদ চৌধুরীকেও।
প্রথম ভিসির মেয়াদ শেষে ২০২৩ সালের শুরুতেই দ্বিতীয় ভিসি হিসেবে নিয়োগ পান স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেন। ডা. এনায়েত হোসেন যোগ দেওয়ার আগেই আগের উপাচার্যের অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা স্থগিত করার নির্দেশনা দেয় মন্ত্রণালয়। এরপর ২২ মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো বেতন-ভাতা পাননি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
নিয়োগের পর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা দ‚র করার আশ্বাস দেন ভিসি ডা. এনায়েত। কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় দুই বছর হলেও এসবের কোনো কিছুই করেননি তিনি। উল্টো কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্য থেকে নিজের পছন্দমতো বিভিন্ন পদে নতুন করে অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেন ভিসি এনায়েত। আগের ভিসির মতো তাঁর বিরুদ্ধেও নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
এই অবস্থায় সৃষ্ট জটিলতা ও বকেয়া বেতনের দাবিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন চলাকালেই গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর থেকে উপাচার্য, রেজিস্ট্রার ও কোষাধ্যক্ষ তিনজনই লাপাত্তা। গত মাসে পদত্যাগ করেছেন রেজিস্ট্রার আবুল কালাম মো. ফজলুর রহমান। তার বিরুদ্ধেও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠেছে।
এসব বিষয়ে কথা বলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক অধ্যাপক ডা. এ এইচএম এনায়েত হোসেনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।