প্রথমে বালতিতে রং গুলিয়ে নিলেন মো. আলম খান (৩৫)। এরপর ট্রেনের একটি বগির যে যে জায়গার রং নষ্ট হয়েছে বা উঠে গেছে, সেসব জায়গা রঙের নিখুঁত পোঁচ দিলেন। রঙের কাজ শেষে সহকর্মীদের সঙ্গে একটি ইঞ্জিনের স্ক্রু ঠিক করাসহ অন্য কাজেও হাত লাগালেন। কাজের এক ফাঁকে পকেট থেকে ছোট একটি মুঠোফোন বের করে মানিকগঞ্জে থাকা বাবার সঙ্গে কথা বললেন।
অন্য কর্মীদের সঙ্গে আলম খানের পার্থক্য হলো, তাঁর দুই হাতের কনুইয়ের পর থেকে আর নেই। জন্মগতভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধী তিনি। এরপরও আলম খান অন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়েই কাজ করছিলেন। দুই হাতের কনুইকে একসঙ্গে করে স্বাভাবিকভাবেই তিনি কাজ করছিলেন। তবে কোনো কোনো কাজে সহকর্মীরা তাঁকে সহায়তা করেন।
গত ৩০ আগস্ট রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনের পাশের ক্যারেজ ও ওয়াগন ডিপোতে গিয়ে খালাসি আলম খানের জীবনযুদ্ধের সাক্ষী হলেন এই প্রতিবেদক।
এই ডিপোতে ট্রেনের ইঞ্জিন ও বগিগুলোকে চলাচলের উপযোগী করতে যা যা করা প্রয়োজন, সেসব কাজ করা হয়। এসব কাজে প্রধান মিস্ত্রিদের সহায়তা করেন খালাসিরা।
প্রধান রেলযান পরীক্ষকের কার্যালয়ের ক্যারেজ ও ওয়াগন ডিপোতে সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় কর্মযজ্ঞ। কোনো ট্রেনের বগির রং নষ্ট হয়েছে, কোনোটার ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দিয়েছে, ট্রেনের কোনো ত্রুটি আছে কি না, সে জন্য নিয়মিত পরীক্ষা করে দেখার (চেকআপ) বিষয় আছে। তাই কাজের যেন অন্ত নেই।
কাজ করতে করতে আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পাশাপাশি সহকর্মীরা বিভিন্নভাবে তাঁকে সহায়তা করেন। বেশির ভাগ সময় হালকা কাজগুলোই তাঁকে দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে ট্রেনের বগি রং করার কাজ করছেন।
আলম খান আগে মাঝেমধ্যে ট্রেনের ছাদে উঠেও কাজ করতেন। তবে ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে প্রধান রেলযান পরীক্ষকের কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী মো. রাফি উদ্দিন তা নিষেধ করেছেন।
রাফি উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আলম খান তাঁর শারীরিক সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করেন। তিনি বর্তমানে রঙের কাজ করছেন। তিনি না করলে এই কাজ অন্য কেউ করতেন। তাই আলম খান কাজ কম করছেন, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। আর তিনি খুব স্বাভাবিকভাবে কাজগুলো করেন। তাই তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আছে—কথাটি কারও মাথাতেই থাকে না। শারীরিক সীমাবদ্ধতার কারণে বেতন ভাতা বা অন্য কোনোভাবে আলম খানের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করার কোনো সুযোগ নেই।
রেলওয়ের এই কর্মকর্তা বলেন, আলম খানদের মতো কারও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলে তিনি যে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন বা তুলনামূলক সেসব কাজে ঝুঁকি কম, সে ধরনের কাজ করানোর নির্দেশনা দেওয়া আছে।
২০১৯ সালে আলম খান খালাসি হিসেবে চাকরি পেয়েছেন। পড়েছেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। তিনি জানালেন, এর আগে বিভিন্ন সরকারি সংস্থায় চাকরির জন্য আবেদন করেছেন। কোনোটার পরীক্ষা দেওয়ার জন্য চিঠিটি তাঁর হাতে পৌঁছেছে, কোনোটা থেকে আবার ডাকও পাননি। আবার এমনও হয়েছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ায় পরীক্ষাও বাতিল হয়ে গেছে।
আলম খানের এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলের বয়স ছয়, মেয়ের চার বছর। মানিকগঞ্জে মা-বাবা ও সন্তানেরা থাকে। আলম খান রাজধানীর তেজগাঁও স্টেশনের কাছে একটি বাসায় ভাড়া থাকেন। সকালে ট্রেনে করে কমলাপুর স্টেশনে যান। কাজ শেষ করে আবার ট্রেনে করেই বাসায় ফেরেন।
আগে নিজেই রান্না করে খেতেন। তবে একার জন্য রান্না করতে গেলে খরচ বেড়ে যায় বলে এখন অন্যদের সঙ্গে খান। কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে নিজের সব কাজ নিজেই করেন। থাকা-খাওয়া বাবদ মাসে খরচ হয় ছয় থেকে সাত হাজার টাকা। তিন মাস পরপর প্রতিবন্ধী ভাতা পান ২ হাজার ৫০০ টাকা। তাই ইচ্ছা থাকলেও মা-বাবা বা পরিবারকে ঢাকায় নিজের কাছে এনে রাখতে পারছেন না বলে জানালেন।
কমলাপুর রেলস্টেশনের ক্যারেজ ও ওয়াগন ডিপোতে নারী ও পুরুষ মিলে প্রায় ১০০ খালাসি কাজ করেন। এর মধ্যে আলম খানই একমাত্র শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি।
আলম খান এখন যে কাজ করছেন, তা করতে খারাপ লাগে, তেমন নয়। তবে রেল ভবন বা মন্ত্রণালয়ে ফাইল আনা-নেওয়াসহ অন্যান্য অফিশিয়াল কাজ পেলে তা তাঁর জন্য বেশি সুবিধার হতো বলে জানালেন।
শারীরিক প্রতিবন্ধী বলে আলম খানের মা-বাবা কখনোই তাঁকে অবহেলা করেননি। পড়াশোনা করাতে চেয়েছেন। তবে আলম খান বেশি দূর পড়তে পারেননি। ছোটবেলা থেকেই মা-বাবা তাঁকে শিখিয়েছেন, মানুষ অনেক কথা বলবে, তাতে কান দিলে চলবে না। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।
আলম খান বলেন, ‘আমার দুই হাত নেই, মানুষের কাছে পাঁচ টাকা চাইলে কেউ কেউ হয়তো টাকা দেব। কিন্তু আমি তা চাই না। নিজে কাজ করে খেতে চাই।’