অসুস্থ গরু-ছাগলকে জরুরি চিকিৎসা দিতে গত বছরের শুরুর দিকে একসঙ্গে ৩৬০টি গাড়ি কেনে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। এতে ব্যয় হয় ১৮৫ কোটি টাকা। কিন্তু অসুস্থ প্রাণীর চিকিৎসার জন্য গ্রামের পথে খুব একটা ছুটছে না গাড়ি। বরং কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত কাজেই এসব গাড়ির ব্যবহার বেশি হচ্ছে।
গাড়ি নিয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কেউ যাচ্ছেন মন্ত্রীর অনুষ্ঠানে। কেউ বাসা–অফিস যাতায়াতে, কেউবা ঘুরতে গেলে এই গাড়ি ব্যবহার করছেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে প্রাণীর চিকিৎসার কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে কেনা গাড়ির অপব্যবহার ঠেকাতে জিপিএস ট্র্যাকার (গাড়ির অবস্থান শনাক্তের প্রযুক্তি) বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।
ক্লিনিকগুলো (গাড়ি) নিয়ে দেশের খামারিদের পাশে দাঁড়ান। আর যেন কোনো গবাদিপশু–পাখি বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়।
মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক বা এমভিসি (ভ্রাম্যমাণ প্রাণিচিকিৎসা ক্লিনিক) নামে পরিচিত এসব গাড়ি কেনা হয়েছে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায়। প্রথম পর্যায়ে দেশের ৩৬০টি উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে গাড়ি দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি গাড়ি কিনতে গড়ে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৫২ লাখ টাকা। গাড়ি কেনার এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা যাতে গাড়ি নিয়ে ঘুরে ঘুরে খামারিদের বাড়িতে বা খামারে গিয়ে অসুস্থ গরু-ছাগলকে চিকিৎসাসেবা দিতে পারেন।
গত বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি ৩৬০টি গাড়ি হস্তান্তর উপলক্ষে ঢাকায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, ‘ক্লিনিকগুলো (গাড়ি) নিয়ে দেশের খামারিদের পাশে দাঁড়ান। আর যেন কোনো গবাদিপশু–পাখি বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়।’ গাড়ির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতেও সেদিন প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন মন্ত্রী।
গাড়ির সঠিক ব্যবহার কতটা হচ্ছে, তা দেখতে গত ২০ জুলাই দুপুরে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক যান মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালে। বেলা আড়াইটায় দপ্তরে ঢুকে জানা গেল, গাড়ি উপজেলায় নেই। উপস্থিত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম গাড়ি নিয়ে ঢাকায় গেছেন। এই তথ্য জানার পরই এই প্রতিবেদক তাঁর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু রিং হলেও ফোন ধরেননি তিনি। পরে আরও দুবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা চলে। কিন্তু তিনি ফোন আর ধরেননি। পরে এই প্রতিবেদক উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার গাড়িচালক ইকবাল হোসেনকে ফোন করেন। তিনি বলেন, ‘স্যারকে নিয়ে ঢাকায় এসেছি।’
টঙ্গিবাড়ী যাওয়ার আগে গত ২০ জুলাই সকালে প্রথমে এই প্রতিবেদক যান মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে জানা যায়, অসুস্থ গরু-ছাগলকে জরুরি চিকিৎসার জন্য দেওয়া গাড়িটি কার্যালয়ে নেই। অসুস্থ কোনো প্রাণীকে চিকিৎসা দিতেও কেউ গাড়ি নিয়ে কোথাও যাননি। পরে জানা যায়, গাড়ি আছে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে দুই কিলোমিটার দূরে একটি ব্যক্তিগত গ্যারেজে।
পরে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা শবনম সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামের রাস্তা সরু থাকার কারণে চিকিৎসার কাজে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় না। নিরাপত্তার কারণে অফিসের ভেতরে গাড়ি রাখার অবস্থাও নেই। তাই মাসে দুই হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে গ্যারেজে রাখা হয়েছে।
উপজেলা পর্যায়ে এ ধরনের বড় গাড়ি দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপজেলা পর্যায়ের পাঁচজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেন, এসব গাড়ি কেনার আগে তাঁদের মতামত নেওয়া হয়নি। গাড়িগুলো আকারে এত বড় যে গ্রামের রাস্তায় চালানো কঠিন।
অবশ্য ভিন্ন চিত্র দেখা গেল ঢাকার কেরানীগঞ্জে। ২৭ জুলাই সকাল সাড়ে নয়টায় এই প্রতিবেদক উপস্থিত হন উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালের সামনে। সকাল ১০টায় দেখা গেল উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মনছুর আহমেদ সেই গাড়ি থেকে নেমে তাঁর দপ্তরে প্রবেশ করছেন। এই দপ্তরের অন্য একজন কর্মী জানান, ‘স্যার, বাসা থেকে এসেছেন।’
উপজেলা পর্যায়ে এ ধরনের বড় গাড়ি দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপজেলা পর্যায়ের পাঁচজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেন, এসব গাড়ি কেনার আগে তাঁদের মতামত নেওয়া হয়নি। গাড়িগুলো আকারে এত বড় যে গ্রামের রাস্তায় চালানো কঠিন। আকারে ছোট হলে গাড়ি নিয়ে সহজেই গ্রামের রাস্তায় যাওয়া যেত। আবার অনেক উপজেলায় প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে গাড়ি রাখার ভালো ব্যবস্থা নেই।
মন্ত্রীর অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ওই গাড়ি ব্যবহার ঠিক হয়নি। এ নিয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছে। আর বরাদ্দের অভাবে নষ্ট হওয়া গাড়ি ঠিক করা যায়নি।
দুর্ঘটনায় নষ্ট তিনটি গাড়ি
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের নির্বাচনী এলাকা পিরোজপুর–১ (পিরোজপুর সদর, নেছারাবাদ ও নাজিরপুর উপজেলা)। মন্ত্রী প্রায়ই তাঁর নির্বাচনী এলাকায় যান। এ বছরের শুরুর দিকে সেখানে একটি অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পথে দুর্ঘটনায় আহত হন পিরোজপুর সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাসহ চারজন। যদিও প্রাণীর চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত গাড়ি নিয়ে মন্ত্রীর অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি।
পিরোজপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা তরুণ কুমার সিকদারের সঙ্গে কথা হয় গত আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রীর অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ওই গাড়ি ব্যবহার ঠিক হয়নি। এ নিয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছে। আর বরাদ্দের অভাবে নষ্ট হওয়া গাড়ি ঠিক করা যায়নি।
একইভাবে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের গাড়িও দুর্ঘটনায় পড়েছিল। সেখানেও ব্যক্তিগত কাজে গাড়ি ব্যবহৃত হচ্ছিল বলে জানান জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের এক কর্মকর্তা।
যত দূর গাড়ি নেওয়া সম্ভব, কর্মকর্তারা তত দূর নেবেন। পরে মোটরসাইকেল চালিয়ে খামারির বাড়িতে যাবেন। তা ছাড়া সব উপজেলায় সরু রাস্তা নেই। অনেক উপজেলায় রাস্তা চওড়া হয়ে গেছে।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জেও একই চিত্র। দুর্ঘটনার পর সেখানকার গাড়িটি নষ্ট অবস্থায় পড়ে আছে বলে জানান প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) পরিচালক আবদুর রহিম। তিনি বলেন, তিনটি গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার পড়েছিল, মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
গরু-ছাগলের চিকিৎসার কাজে কেনা গাড়ি কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি তাঁদেরও নজরে এসেছে। অপব্যবহার বন্ধে গাড়িতে জিপিএস ট্র্যাকার লাগানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে করে ব্যক্তিগত কাজে গাড়ির ব্যবহার কমে আসবে বলে আশাবাদী তিনি।
প্রকল্প পরিচালক আবদুর রহিমের সঙ্গে গত ২২ আগস্ট ঢাকার ফার্মগেটে তাঁর দপ্তরে যখন কথা হচ্ছিল, তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন একই প্রকল্পের চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর (প্রধান কারিগরি সমন্বয়ক) গোলাম রব্বানীও।
গ্রামীণ রাস্তায় চলাচলের জন্য এ ধরনের গাড়ি বাছাইয়ের কারণ কী, এমন প্রশ্নে গোলাম রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, ‘যত দূর গাড়ি নেওয়া সম্ভব, কর্মকর্তারা তত দূর নেবেন। পরে মোটরসাইকেল চালিয়ে খামারির বাড়িতে যাবেন। তা ছাড়া সব উপজেলায় সরু রাস্তা নেই। অনেক উপজেলায় রাস্তা চওড়া হয়ে গেছে।’
দেশে গরুর দুধের উৎপাদন বাড়াতে ২০১৮ সালে এই প্রকল্প (এলডিডিপি) অনুমোদন হয়। তখন প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৪ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ঋণ হিসেবে দিচ্ছে ৩ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা।
এ ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। তাই এসব পড়ে আছে।