গত জুনে দিল্লিতে অনন্ত সেন্টারের সঙ্গে সিপিডি বাংলাদেশ-ভারত কৌশলগত সংলাপের আয়োজন করেছিল। এর প্রেক্ষাপট কী ছিল?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক শুধু মুক্তিযুদ্ধের কারণে নয়, এটা বর্তমান ও ভবিষ্যতের উন্নয়ন, শান্তি ও নিরাপত্তার জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই উপলব্ধি থেকেই সিপিডি বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কের বিষয়টিকে ধারাবাহিকভাবে একটি গঠনমূলক ও ইতিবাচক আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত করার চেষ্টা করে এসেছে। আজকে সবাই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে যে জায়গায় দেখছেন, এই চেষ্টাটা তাঁদের কাছে অকল্পনীয় মনে হতে পারে। বৈরী একটা পরিস্থিতির ভেতরে তথ্য ও নীতি পর্যালোচনাভিত্তিক সেই কাজটা করে যেতে হয়েছে। সেই লক্ষ্যেই ভারতের বিভিন্ন চিন্তক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সিপিডি কাজ করে চলেছে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার অনন্ত সেন্টারের সঙ্গে দুই দিনের আলোচনাটা হয়েছে। এটি তাদের সঙ্গে দ্বিতীয়বারের মতো আলোচনা।
এবার এ সময়ে আলোচনা আয়োজনের কি বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য ছিল?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: এ সময়ে সংলাপ আয়োজনের কারণ হলো উভয় দেশই নির্বাচনের দিকে এগিয়ে চলেছে। এ কারণে নির্বাচনের প্রাক্কালে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের একটা মূল্যায়নের ভেতর দিয়ে তারা যেতে পারে। নির্বাচনের পর এই সম্পর্কের সম্ভাব্য বিবর্তনের সম্ভাবনাও আলোচনায় চলে আসে। অর্থাৎ দুই দেশের সম্পর্ককে একধরনের অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে পুনর্বিবেচনার সময়ে আমরা উপনীত হয়েছি।
এক দশক ধরে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত ও গভীর হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখার বিষয় হয়ে উঠেছে উভয় দেশের অভিন্ন স্বার্থের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষিত হয়েছে কি না। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা এবং অনুমানযোগ্যতা কতটা থাকতে পারে। দেখা দরকার, সম্পর্কের অর্জনকে টেকসই করা এবং কোনো সংস্কারের প্রয়োজন হলে তা নিশ্চিত করার সুযোগ আছে কি না। রাজনৈতিক কোনো ক্রান্তিকালে উপনীত হলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন আসবে কি না কিংবা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে সম্পর্কের সম্ভাবনা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়াবে কি না, তা মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।
তার মানে নির্বাচন সামনে রেখে এ আলোচনার আয়োজন কাকতালীয় নয়?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: যখনই বসি, তখন আলোচনার একটা পরিপ্রেক্ষিত থাকে। প্রথমবার অনন্ত সেন্টারের সঙ্গে আমাদের আলোচনাটি হয়েছিল ভার্চ্যুয়ালি। সে সময় আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল কোভিড মোকাবিলা এবং কোভিড–উত্তর পরিস্থিতিতে টিকাসহ নানা ধরনের ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী, অক্সিজেন ও অ্যাম্বুলেন্স সরবরাহসহ উন্নয়ন সহযোগিতার অভিজ্ঞতা আলোচনা। আশা করি, আগামী বছর আমরা ঢাকায় তৃতীয় আলোচনার আয়োজন করতে পারব।
২০১৪ সালের নির্বাচনে ভারতে বিজেপির জয়লাভের পর বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কে পরিবর্তন আসতে পারে বলে ভাবা হয়েছিল। কারণ, কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক ঐতিহাসিক এবং প্রমাণিত। কিন্তু ভারতে ক্ষমতার পালাবদল হলেও দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে গেছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আমি মনে করি, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ–ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনটি বড় অর্জন আছে। প্রথমটি হলো ১৯৯৬ সালে গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি সই। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ২০০৯ সাল থেকে এক দেশের ভূখণ্ড অন্য দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা ব্যাহত করতে ব্যবহার হতে না দেওয়া। তৃতীয় হলো, ২০১৫ সালে স্থলসীমান্ত চুক্তির প্রটোকলের বাস্তবায়ন।
১৯৯৬, ২০০৯ ও ২০১৫ সাল—এই তিন সময়ে ভারতের তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের এসব ঐতিহাসিক চুক্তি হয়েছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের নীতি কেমন হবে, তা নিয়ে ভারতের দলমত-নির্বিশেষে রাজনৈতিক অবস্থান যথেষ্ট পরিষ্কার ও শক্তিশালী, যা সম্পর্কের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক। অথচ আমাদের দেশে প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন অবস্থান অনুপস্থিত। লক্ষণীয়, গুরুত্বপূর্ণ এসব অর্জনের সময় বাংলাদেশে তিনবারই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল।
গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্র প্রতিবেশীর সঙ্গে ফলপ্রসূ এবং কার্যকর সম্পর্ক অর্জন করতে চাইলে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিসরে শাসকদল ও বিরোধী দলের মতৈক্য অপরিহার্য। দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার কাঠামো ও উপাদান নিয়ে রাজনৈতিক মতৈক্য থাকা মানে এই নয় যে বাস্তবায়ন পরিকল্পনার খুঁটিনাটি নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারবে না।
তার মানে সম্পর্কের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভারতে যে রাজনৈতিক মতৈক্য আছে, বাংলাদেশে তার অনুপস্থিতিকে আপনি বড় সমস্যা হিসেবে দেখছেন?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক মতৈক্যের বিষয়টি অনুপস্থিত। ২০১৪ সালে ভারতে কংগ্রেসের পরিবর্তে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর শুরুর দিকে আমাদের ভয়ভীতি কি কম ছিল? আমরা তো এই সম্পর্কের গতিময়তার ভেতর দিয়েই তার মধ্যে সামঞ্জস্য এনেছি। কংগ্রেসের প্রতি আওয়ামী লীগের একধরনের ঝোঁক থাকলেও পরে তারা বিজেপির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। এক দেশের বিশেষ কোনো দলের প্রতি অন্য দেশের অগ্রাধিকার বা পছন্দ থাকতেই পারে। কিন্তু গণতান্ত্রিক পরিবেশে কোনো একটি দেশের মানুষই তার দেশের সরকার নির্বাচিত করবে। তাই ক্ষমতায় যে–ই আসুক না কেন, তার সঙ্গে যে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে হবে, এই মানসিকতা থাকতে হবে। দুটি দেশের সম্পর্ক কোনো একটি শাসকদলের হাতে জিম্মি হতে পারে না। আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
এ পরিপ্রেক্ষিতে দুই নিকট প্রতিবেশীর সম্পর্কের বিষয়ে অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক মতৈক্য গড়ে তোলার এবং কার্যকর করার লক্ষ্যে অন্যান্য অংশীজনকে যুক্ত করা জরুরি। নইলে সম্পর্কের ইতিবাচক দিকগুলো টেকসই হবে না।