০৭:৩১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এফডিসির একাল-সেকাল ২: ডিজিটালে পিছিয়ে, ‘ডুবছে’ মামলা-দুর্নীতিতেও

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার দেলোয়ার জাহান ঝন্টু তাঁর অনেক চলচ্চিত্রের শুটিং করেছেন বিএফডিসিতে। তবে গত ১৫ বছরে তিনি সেখানে চলচ্চিত্রের কোনো কাজ করেননি। তাঁর ভাষ্য, ‘বিএফডিসিতে একবেলা শুটিং করতে যে ভাড়া লাগে, বাইরে তার চেয়ে অনেক কম টাকায় কাজ করা যায়। এখানে কাজ শেষ করে পুরো টাকা পরিশোধ করে বের হতে হয়। পরে পরিশোধ করার সুযোগ নেই।’

দেলোয়ার জাহান ঝন্টু বললেন, এফডিসিতে কেন শুটিং কমে গেছে, তা জানার জন্য প্রযোজক, পরিচালকদের এফডিসি কর্তৃপক্ষ কখনো ডাকেও না। এ বিষয়ে কোনো গরজই নেই।

প্রায় একই কথার প্রতিধ্বনি করলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিপুণ আক্তার। এই চিত্রনায়িকা বললেন, ‘এফডিসির ক্যামেরা গরম হয়ে যাচ্ছে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এফডিসির ভেতরে শুটিং স্পট বলতে সেই ঝরনা স্পট, তাও আবার নষ্ট। বাগান বলতে কয়েকটা গাছ। এই ঝরনা স্পট বা বাগানে এই ২০২৩ সালে কেউ শুটিং করতে চাইবেন?’

চলচ্চিত্রশিল্প অ্যানালগ থেকে ডিজিটালে লাফ দিলেও দুইয়ের মধ্যখানে গ্যাপ বা ফারাকটা অনেক বেশি। এফডিসির সঙ্গে শিল্পী থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। অ্যানালগের স্বর্ণযুগের সময়টাকে ধরে এফডিসিকে চিন্তাভাবনায় আমূল পরিবর্তন এনে সবকিছুই ডিজিটাল ফরম্যাটে করতে হবে।

আলমগীর, নায়ক ও পরিচালক

এফডিসির সিঁড়ির এক অংশে এমন অবস্থা
এফডিসির সিঁড়ির এক অংশে এমন অবস্থাছবি: প্রথম আলো

অথচ এফডিসিতে নির্মিত ১৯৬৩ সালে জহির রায়হানের ‘কাচের দেয়াল’ পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসবে পাঁচটি শাখায় পুরস্কার পায়। এফডিসি স্বয়ংসম্পূর্ণ স্টুডিও ছিল, তার প্রমাণ ১৯৬৫ সালে এফডিসি থেকে নির্মিত হয় পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সংগম’। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছিলেন জহির রায়হান।

১৯৯৩ সালে প্রকাশিত মির্জা তারেকুল কাদেরের গবেষণাগ্রন্থ ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প’-এ উল্লেখ করা হয়েছে, বিএফডিসিতে দেশের মোট চলচ্চিত্রের ইনডোর শুটিংয়ের ৮০ ভাগ, রঙিন প্রসেসিং ও প্রিন্টিংয়ের ১০০ ভাগ, রেকর্ডিংয়ের ৯০ ভাগ, ডাবিং ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের ৮০ ভাগ এবং এফেক্টস সাউন্ডের ১০০ ভাগ কাজ হতো। তবে এই সবই এখন অতীত।

অফিসের ভেতর কাপড় শুকাতে দেওয়া হয়েছে
অফিসের ভেতর কাপড় শুকাতে দেওয়া হয়েছেছবি: প্রথম আলো

উত্তরণে নজর নেই কর্তৃপক্ষের

একাধিক পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা-অভিনেত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএফডিসিতে কাজের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দিকে কর্তৃপক্ষ কখনো নজর দেয়নি। এফডিসির ভেতরে কমপ্লেক্স তৈরির জন্য ৩, ৪ ও ৫ নম্বর ফ্লোর ভেঙে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে পাঁচটি ফ্লোর আছে। একটি ফ্লোর শীততাপনিয়ন্ত্রিত; অন্য ফ্লোরের শীতাতপনিয়ন্ত্রণের যন্ত্রটি নষ্ট।

‘একটি সিনেমার গল্প’ চিত্রনায়ক আলমগীর পরিচালিত ষষ্ঠ চলচ্চিত্র। ২০১৮ সালে মুক্তি পায় এটি। নয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা পাওয়া আলমগীর এফডিসিতে তাঁর এই চলচ্চিত্রের কাজ করার অভিজ্ঞতায় বললেন, ‘কালার কারেকশন করতে কষ্ট হয়েছে। শতভাগ কাজ হয়নি। বড় স্ক্রিন থাকলে সময় কম লাগত। এফডিসি সাউন্ডের জন্য কিছু যন্ত্রপাতি এনেছিল, তা কোনো কাজেই লাগেনি। তাহলে তা কিনেছিল কেন?’

আলমগীর প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন ১৯৭২ সালের ২৪ জুন। ২০০০ সাল থেকে চলচ্চিত্রে কাজ কমিয়ে দিয়েছেন। এই চিত্রনায়ক বললেন, ‘এফডিসিতে কাজ করলে আমি কমফোর্ট ফিল করি। সারা জীবনের অভ্যাস। খরচের কথা ভাবিনি বলে আর ভালোবাসা থেকেই এফডিসিতে কাজ করেছি। কিন্তু বেশির ভাগ প্রযোজক-পরিচালকদের এফডিসিতে কাজের যে অনীহা, তার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। সেই কারণটা খুঁজে বের করতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে বেশি খরচ করে কেন কাজ করতে হচ্ছে, তাও দেখতে হবে।’

বিএফডিসির আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ (সংশোধিত) প্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় এক্সটার্নাল অডিট বা বাইরের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অডিট করা হয়নি। প্রকল্পের ক্রয় পরিকল্পনায় ক্রয়ের বরাদ্দ বাংলাদেশি টাকায় উল্লেখ করা হলেও চুক্তিমূল্য ইউরো, ইউএসডিতে দেখানো হয়েছে।

এফডিসিকে চলচ্চিত্রের তীর্থস্থান হিসেবে উল্লেখ করে নায়ক আলমগীর আরও বললেন, ‘২৩০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি। জীবনের ৭৪ বছরের মধ্যে ৫১ বছরই কেটেছে চলচ্চিত্রজগতে। চলচ্চিত্রশিল্প অ্যানালগ থেকে ডিজিটালে লাফ দিলেও দুইয়ের মাঝখানে গ্যাপ বা ফারাকটা অনেক বেশি। এফডিসির সঙ্গে শিল্পী থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। অ্যানালগের স্বর্ণযুগের সময়টাকে ধরে এফডিসিকে চিন্তাভাবনায় আমূল পরিবর্তন এনে সবকিছুই ডিজিটাল ফরম্যাটে করতে হবে।’

ডিজিটালে পিছিয়ে বিএফডিসি

অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল সিনেমার জগতে প্রবেশ করতে গিয়ে হোঁচট খায় এফডিসি। এরপর আর প্রতিষ্ঠানটি সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।

২০১১ সালে এফডিসি সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নে ৫৯ কোটি ১৮ লাখ টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। ২০১৪ সালে বিএফডিসিতে প্রথম ডিজিটাল ক্যামেরা আসে। অথচ এর আগে ২০১২ সালে দেশে জাজ মাল্টিমিডিয়ার হাত ধরে ডিজিটাল চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু হয়। ফলে এফডিসি প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে।

রঙিন চলচ্চিত্র নির্মাণে ১৯৮৩ সালে এফডিসিতে ‘জহির রায়হান ল্যাবরেটরি’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। দিনের বেলাতেও ল্যাবের ভেতর স্তূপ করে রাখা যন্ত্রপাতিগুলো মুঠোফোনের আলো জ্বেলে দেখতে হলো। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা জানালেন, কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে, একই সঙ্গে স্মৃতিও হারিয়ে যাচ্ছে। একটি মেশিনের গায়ে স্কচটেপ দিয়ে আটকানো কাগজে লেখা-‘দিন যায় কথা থাকে’। এটি ১৯৭৯ সালের মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র।

এফডিসি নিয়ে কথা বলছেন নায়ক আলমগীর
এফডিসি নিয়ে কথা বলছেন নায়ক আলমগীরছবি: মানসুরা হোসাইন

লেখাটি কর্মীদের দীর্ঘশ্বাসেরই যেন প্রতিনিধিত্ব করছে। এফডিসিতে একটি জাদুঘর চালু করে অ্যানালগ আমলের যন্ত্রপাতিগুলো প্রদর্শনের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে তা আমলে নেওয়া হয়নি।

অন্যদিকে ডিজিটাল আমলের যন্ত্রপাতি কেনা বা অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় অনিয়ম হওয়ার অভিযোগ আছে। যন্ত্রপাতি থাকলেও তা চালানোর জন্য দক্ষ জনবল নেই।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেওয়া হিসাবে, বিএফডিসিতে বর্তমানে মোট আটটি ক্যামেরা আছে। এর মধ্যে সনি এফ-৫৫ ক্যামেরা পাঁচটি। একটি নষ্ট। রেড ড্রাগন ক্যামেরা দুটির মধ্যে একটি নষ্ট। একটির মেরামতের কাজ চলছে। স্কারলেট ক্যামেরা একটি চালু আছে। এডিটিংয়ের জন্য ফ্রিল্যান্সার দিয়ে কাজ করতে হয়। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের জন্য ৫ দশমিক ১ সাউন্ড সিস্টেম সফটওয়্যার নষ্ট তিন বছরের বেশি সময় ধরে। প্রায় পাঁচ কোটি টাকার সাউন্ড মিক্সিংয়ের দুটি মেশিন নষ্ট।

মেরামত করার টাকা নেই। প্রায় এক কোটি টাকার দুটি জিমিজিব ক্রেন (৪০ ফুট) থাকলেও তা চালানোর জন্য দক্ষ জনবল নেই। কেউ কাজ করতে চাইলে বাইরে থেকে লোক ভাড়া করে আনতে হয়।

বিষয়

এফডিসির একাল-সেকাল ২: ডিজিটালে পিছিয়ে, ‘ডুবছে’ মামলা-দুর্নীতিতেও

প্রকাশিত: ০২:৫২:৩৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার দেলোয়ার জাহান ঝন্টু তাঁর অনেক চলচ্চিত্রের শুটিং করেছেন বিএফডিসিতে। তবে গত ১৫ বছরে তিনি সেখানে চলচ্চিত্রের কোনো কাজ করেননি। তাঁর ভাষ্য, ‘বিএফডিসিতে একবেলা শুটিং করতে যে ভাড়া লাগে, বাইরে তার চেয়ে অনেক কম টাকায় কাজ করা যায়। এখানে কাজ শেষ করে পুরো টাকা পরিশোধ করে বের হতে হয়। পরে পরিশোধ করার সুযোগ নেই।’

দেলোয়ার জাহান ঝন্টু বললেন, এফডিসিতে কেন শুটিং কমে গেছে, তা জানার জন্য প্রযোজক, পরিচালকদের এফডিসি কর্তৃপক্ষ কখনো ডাকেও না। এ বিষয়ে কোনো গরজই নেই।

প্রায় একই কথার প্রতিধ্বনি করলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিপুণ আক্তার। এই চিত্রনায়িকা বললেন, ‘এফডিসির ক্যামেরা গরম হয়ে যাচ্ছে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এফডিসির ভেতরে শুটিং স্পট বলতে সেই ঝরনা স্পট, তাও আবার নষ্ট। বাগান বলতে কয়েকটা গাছ। এই ঝরনা স্পট বা বাগানে এই ২০২৩ সালে কেউ শুটিং করতে চাইবেন?’

চলচ্চিত্রশিল্প অ্যানালগ থেকে ডিজিটালে লাফ দিলেও দুইয়ের মধ্যখানে গ্যাপ বা ফারাকটা অনেক বেশি। এফডিসির সঙ্গে শিল্পী থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। অ্যানালগের স্বর্ণযুগের সময়টাকে ধরে এফডিসিকে চিন্তাভাবনায় আমূল পরিবর্তন এনে সবকিছুই ডিজিটাল ফরম্যাটে করতে হবে।

আলমগীর, নায়ক ও পরিচালক

এফডিসির সিঁড়ির এক অংশে এমন অবস্থা
এফডিসির সিঁড়ির এক অংশে এমন অবস্থাছবি: প্রথম আলো

অথচ এফডিসিতে নির্মিত ১৯৬৩ সালে জহির রায়হানের ‘কাচের দেয়াল’ পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসবে পাঁচটি শাখায় পুরস্কার পায়। এফডিসি স্বয়ংসম্পূর্ণ স্টুডিও ছিল, তার প্রমাণ ১৯৬৫ সালে এফডিসি থেকে নির্মিত হয় পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সংগম’। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছিলেন জহির রায়হান।

১৯৯৩ সালে প্রকাশিত মির্জা তারেকুল কাদেরের গবেষণাগ্রন্থ ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প’-এ উল্লেখ করা হয়েছে, বিএফডিসিতে দেশের মোট চলচ্চিত্রের ইনডোর শুটিংয়ের ৮০ ভাগ, রঙিন প্রসেসিং ও প্রিন্টিংয়ের ১০০ ভাগ, রেকর্ডিংয়ের ৯০ ভাগ, ডাবিং ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের ৮০ ভাগ এবং এফেক্টস সাউন্ডের ১০০ ভাগ কাজ হতো। তবে এই সবই এখন অতীত।

অফিসের ভেতর কাপড় শুকাতে দেওয়া হয়েছে
অফিসের ভেতর কাপড় শুকাতে দেওয়া হয়েছেছবি: প্রথম আলো

উত্তরণে নজর নেই কর্তৃপক্ষের

একাধিক পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা-অভিনেত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএফডিসিতে কাজের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দিকে কর্তৃপক্ষ কখনো নজর দেয়নি। এফডিসির ভেতরে কমপ্লেক্স তৈরির জন্য ৩, ৪ ও ৫ নম্বর ফ্লোর ভেঙে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে পাঁচটি ফ্লোর আছে। একটি ফ্লোর শীততাপনিয়ন্ত্রিত; অন্য ফ্লোরের শীতাতপনিয়ন্ত্রণের যন্ত্রটি নষ্ট।

‘একটি সিনেমার গল্প’ চিত্রনায়ক আলমগীর পরিচালিত ষষ্ঠ চলচ্চিত্র। ২০১৮ সালে মুক্তি পায় এটি। নয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা পাওয়া আলমগীর এফডিসিতে তাঁর এই চলচ্চিত্রের কাজ করার অভিজ্ঞতায় বললেন, ‘কালার কারেকশন করতে কষ্ট হয়েছে। শতভাগ কাজ হয়নি। বড় স্ক্রিন থাকলে সময় কম লাগত। এফডিসি সাউন্ডের জন্য কিছু যন্ত্রপাতি এনেছিল, তা কোনো কাজেই লাগেনি। তাহলে তা কিনেছিল কেন?’

আলমগীর প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন ১৯৭২ সালের ২৪ জুন। ২০০০ সাল থেকে চলচ্চিত্রে কাজ কমিয়ে দিয়েছেন। এই চিত্রনায়ক বললেন, ‘এফডিসিতে কাজ করলে আমি কমফোর্ট ফিল করি। সারা জীবনের অভ্যাস। খরচের কথা ভাবিনি বলে আর ভালোবাসা থেকেই এফডিসিতে কাজ করেছি। কিন্তু বেশির ভাগ প্রযোজক-পরিচালকদের এফডিসিতে কাজের যে অনীহা, তার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। সেই কারণটা খুঁজে বের করতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে বেশি খরচ করে কেন কাজ করতে হচ্ছে, তাও দেখতে হবে।’

বিএফডিসির আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ (সংশোধিত) প্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় এক্সটার্নাল অডিট বা বাইরের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অডিট করা হয়নি। প্রকল্পের ক্রয় পরিকল্পনায় ক্রয়ের বরাদ্দ বাংলাদেশি টাকায় উল্লেখ করা হলেও চুক্তিমূল্য ইউরো, ইউএসডিতে দেখানো হয়েছে।

এফডিসিকে চলচ্চিত্রের তীর্থস্থান হিসেবে উল্লেখ করে নায়ক আলমগীর আরও বললেন, ‘২৩০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি। জীবনের ৭৪ বছরের মধ্যে ৫১ বছরই কেটেছে চলচ্চিত্রজগতে। চলচ্চিত্রশিল্প অ্যানালগ থেকে ডিজিটালে লাফ দিলেও দুইয়ের মাঝখানে গ্যাপ বা ফারাকটা অনেক বেশি। এফডিসির সঙ্গে শিল্পী থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। অ্যানালগের স্বর্ণযুগের সময়টাকে ধরে এফডিসিকে চিন্তাভাবনায় আমূল পরিবর্তন এনে সবকিছুই ডিজিটাল ফরম্যাটে করতে হবে।’

ডিজিটালে পিছিয়ে বিএফডিসি

অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল সিনেমার জগতে প্রবেশ করতে গিয়ে হোঁচট খায় এফডিসি। এরপর আর প্রতিষ্ঠানটি সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।

২০১১ সালে এফডিসি সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নে ৫৯ কোটি ১৮ লাখ টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। ২০১৪ সালে বিএফডিসিতে প্রথম ডিজিটাল ক্যামেরা আসে। অথচ এর আগে ২০১২ সালে দেশে জাজ মাল্টিমিডিয়ার হাত ধরে ডিজিটাল চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু হয়। ফলে এফডিসি প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে।

রঙিন চলচ্চিত্র নির্মাণে ১৯৮৩ সালে এফডিসিতে ‘জহির রায়হান ল্যাবরেটরি’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। দিনের বেলাতেও ল্যাবের ভেতর স্তূপ করে রাখা যন্ত্রপাতিগুলো মুঠোফোনের আলো জ্বেলে দেখতে হলো। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা জানালেন, কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে, একই সঙ্গে স্মৃতিও হারিয়ে যাচ্ছে। একটি মেশিনের গায়ে স্কচটেপ দিয়ে আটকানো কাগজে লেখা-‘দিন যায় কথা থাকে’। এটি ১৯৭৯ সালের মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র।

এফডিসি নিয়ে কথা বলছেন নায়ক আলমগীর
এফডিসি নিয়ে কথা বলছেন নায়ক আলমগীরছবি: মানসুরা হোসাইন

লেখাটি কর্মীদের দীর্ঘশ্বাসেরই যেন প্রতিনিধিত্ব করছে। এফডিসিতে একটি জাদুঘর চালু করে অ্যানালগ আমলের যন্ত্রপাতিগুলো প্রদর্শনের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে তা আমলে নেওয়া হয়নি।

অন্যদিকে ডিজিটাল আমলের যন্ত্রপাতি কেনা বা অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় অনিয়ম হওয়ার অভিযোগ আছে। যন্ত্রপাতি থাকলেও তা চালানোর জন্য দক্ষ জনবল নেই।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেওয়া হিসাবে, বিএফডিসিতে বর্তমানে মোট আটটি ক্যামেরা আছে। এর মধ্যে সনি এফ-৫৫ ক্যামেরা পাঁচটি। একটি নষ্ট। রেড ড্রাগন ক্যামেরা দুটির মধ্যে একটি নষ্ট। একটির মেরামতের কাজ চলছে। স্কারলেট ক্যামেরা একটি চালু আছে। এডিটিংয়ের জন্য ফ্রিল্যান্সার দিয়ে কাজ করতে হয়। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের জন্য ৫ দশমিক ১ সাউন্ড সিস্টেম সফটওয়্যার নষ্ট তিন বছরের বেশি সময় ধরে। প্রায় পাঁচ কোটি টাকার সাউন্ড মিক্সিংয়ের দুটি মেশিন নষ্ট।

মেরামত করার টাকা নেই। প্রায় এক কোটি টাকার দুটি জিমিজিব ক্রেন (৪০ ফুট) থাকলেও তা চালানোর জন্য দক্ষ জনবল নেই। কেউ কাজ করতে চাইলে বাইরে থেকে লোক ভাড়া করে আনতে হয়।