অর্থনীতির গতি কমে যাওয়ার কারণে চীন শিগগিরই বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশ হতে পারছে না। এমনকি ভবিষ্যতে কোনো এক সময় তারা শীর্ষস্থানে উঠলেও বেশি দিন সেখানে থাকতে পারবে না। চীনের অর্থনীতিতে যে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে, সেটি অনেক গভীর হচ্ছে।
ব্লুমবার্গ ইকোনমিকসের সূত্রে ইকোনমিক টাইমস জানিয়েছে, এখন ধারণা করা হচ্ছে, ২০৪০-এর দশকের মধ্যভাগে চীনের জিডিপি মার্কিন জিডিপি ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবে সেটা ঘটলেও চীন যে খুব বেশি এগিয়ে যেতে পারবে, তা নয়। এমনকি বেশি দিন তারা শীর্ষস্থানে থাকতে পারবে, তা–ও মনে করে না ব্লুমবার্গ ইকোনমিকস। অথচ মহামারির আগে তাদের ধারণা ছিল, চীন ২০৩০-এর দশকের শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে।
এক গবেষণা নোটে ব্লুমবার্গের অর্থনীতিবিদেরা লিখেছেন, প্রত্যাশার অনেক আগেই চীনের অর্থনীতি গতি হারিয়ে ফেলেছে। কোভিড-উত্তর সময়ে চীনের অর্থনীতি যে গতি পেয়েছিল, খুব দ্রুতই তা খেই হারিয়ে ফেলেছে। দেশটির আবাসন খাতের সংকট যে ঘনিয়ে উঠতে শুরু করেছে, তা অর্থনীতির দুর্গতিরই লক্ষণ। বেইজিংয়ের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ওপর থেকেও সংশ্লিষ্টদের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে যাচ্ছে।
ঝুঁকিটা হলো, এই আত্মবিশ্বাসের অভাব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এবং তাতে প্রবৃদ্ধির গতি দীর্ঘ সময়ের জন্য কমে যেতে পারে।
অর্থনীতিবিদেরা এখন মনে করছেন, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের প্রবৃদ্ধির হার ২০৩০ সালে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০৫০ সালে ১ শতাংশে নেমে আসতে পারে; যদিও পূর্বাভাস ছিল, এ হার হবে যথাক্রমে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ ও ১ দশমিক ৬ শতাংশ।
২০২২ সালে চীনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ শতাংশ, এমনকি কোভিডের বছর ২০২০ সালেও প্রবৃদ্ধি হয়েছিল এর চেয়ে বেশি। কিন্তু তারা দীর্ঘ সময় কোভিডজনিত বিধিনিষেধ আরোপ করে রেখেছিল। এরপর গত বছরের শেষ দিকে জনবিক্ষোভের মুখে তারা বিধিনিষেধ তুলে নিলেও অর্থনীতির পালে তেমন একটা হাওয়া লাগেনি।
দেশটির রপ্তানি কমে গেছে এবং সেই সঙ্গে আবাসন খাতের দুরবস্থা আরও দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। আর সে কারণে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পালে তেমন একটা হাওয়া আর লাগবে না। মানুষ ব্যয় করার বেলায় অনেকটা সতর্ক। সে কারণে বেসরকারি খাতের তৎপরতা অনেকটা কমে গেছে। চীনের অর্থনীতিবিদদের নিয়ে ব্লুমবার্গ যে জরিপ করেছে, সেখানে তাঁরা বলেছেন, ২০২৪ সালে চীনের প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের নিচে নেমে যাবে।
চীনের বর্তমান পরিস্থিতি একধরনের ‘ব্যালেন্সশিট রিসেশন’। এ পরিস্থিতিতে মানুষ বিনিয়োগ করে অর্থের পরিমাণ বাড়ানোর চেয়ে ঋণের অঙ্ক হ্রাসের দিকে বেশি নজর দেয়। ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাইওয়ান বংশোদ্ভূত মার্কিন অর্থনীতিবিদ রিচার্ড কু ‘ব্যালেন্সশিট রিসেশন’ কথাটি প্রচলন করেন। তিনি জাপানের নোমুরা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান অর্থনীতিবিদ।
ব্যালেন্সশিট রিসেশনের সময়ে পারিবারিক ও ব্যবসায়িক সম্পদের মূল্য কমে যায়। এতে অর্থনীতির ভারসাম্য নষ্ট হয়। মানুষ আরও বেশি সঞ্চয়মুখী হয়, কমে যায় বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ।
চীন কবে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে, এ নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংস্থা পূর্বাভাস দিয়েছে। কিন্তু বারবার দিনক্ষণ পিছিয়ে দেওয়া এবং চীনের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে একসময় সন্দেহ সৃষ্টি হয়, আদৌ চীনের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাপিয়ে যাওয়া সম্ভব কি না। এরই মধ্যে দেশটির উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধির হার কমে যাবে, কমবে তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা। চীনের শ্রমশক্তি ইতিমধ্যে কমতে শুরু করেছে, যে হ্রাসের গতি নিকটভবিষ্যতে আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হয়। ১৯৬০ সালের পর গত বছর এই প্রথম দেশটির জনসংখ্যা কমেছে।
সেই তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র ভালো অবস্থানে আছে। নীতি সুদহার বাড়ানোর কারণে দেশটি মন্দার কবলে পড়বে, এমন আশঙ্কা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা ঘটেনি। ২০২২-২৩ অর্থবছরেও প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস আছে। তবে ২০৫০ সাল নাগাদ দেশটির প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে। তবে পূর্বাভাস অনুযায়ী, তখন চীনের চেয়ে তাদের প্রবৃদ্ধির হার থাকবে বেশি।
এ পরিস্থিতিতে চীন কবে নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রকে ছাপিয়ে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতি হতে পারবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যায় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।