০৭:০৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বেওয়ারিশ লাশ, মেসেঞ্জার বার্তা ও একটি খুনের রহস্য উদ্‌ঘাটন

২০১৮ সালের একটি খুনের মামলার রহস্য উদ্‌ঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। খুনিরা ধরা পড়েছেন ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম মেসেঞ্জার বার্তার সূত্র ধরে।

খুন হয়েছিলেন গাজীপুরের কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ছাত্র আবদুল্লাহ আল মামুন (১৮)। তাঁর বন্ধুরা তাঁকে গলা কেটে হত্যা করেন। তাঁর লাশ দাফন হয়েছিল বেওয়ারিশ হিসেবে।

অবশ্য পরে মামুনের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু গাজীপুর থানার পুলিশ খুনের রহস্যের কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি। অবশেষে পিবিআই খুনের রহস্য বের করে সম্প্রতি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে।

মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র ও তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের ১৩ মার্চ গাজীপুরের জয়দেবপুর থানার দক্ষিণখান বাইপাস-সংলগ্ন দিঘির দক্ষিণ পাশের এক জায়গা থেকে মানুষের বিচ্ছিন্ন একটি মাথা ও কাছের আরেক জায়গায় ক্ষতবিক্ষত একটি লাশ উদ্ধার করা হয়। সেটি কিছুদিন গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের মর্গে পড়ে ছিল। লাশটি কেউ শনাক্ত করেনি, দাবিও করেনি।

পরে লাশটি বেওয়ারিশ হিসেবে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কবরস্থানে দাফন করা হয়। আর পুলিশের এক উপপরিদর্শক (এসআই) বাদী হয়ে অজ্ঞাত তরুণ খুনের ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে জয়দেবপুর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।

একই সময় নিহত মামুনের বাবা তাঁর ছেলে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় জয়দেবপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন। ওই জিডির সূত্রে কবর থেকে মামুনের লাশ তোলা হয়। পরে স্বজনেরা তাঁর লাশ শনাক্ত করেন।

মামুন হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্‌ঘাটনের কোনো সূত্র ছিল না। পিবিআই তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর তাঁরা মামুনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু হত্যার উদ্দেশ্য বা অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে মামুনের পরিবার কোনো তথ্য দিতে পারেনি।

মো. হাফিজুর রহমান, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা

লাশ উদ্ধারের ঘটনাস্থল গাজীপুর মহানগর এলাকায় হওয়ায় মামুন হত্যা মামলার তদন্তভার জয়দেবপুর থানা থেকে গাজীপুর সদর থানায় স্থানান্তর করা হয়। দেড় বছর পর ২০১৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর গাজীপুর সদর থানার পুলিশ হত্যাকারীদের শনাক্ত করতে না পেরে মামলাটিতে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। ২০২০ সালের ১৮ মার্চ আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই গাজীপুরের পরিদর্শক মো. হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মামুন হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্‌ঘাটনের কোনো সূত্র ছিল না। পিবিআই তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর তাঁরা মামুনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু হত্যার উদ্দেশ্য বা অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে মামুনের পরিবার কোনো তথ্য দিতে পারেনি।

হাফিজুর রহমান আরও বলেন, মামুনকে হত্যার পর তাঁর মুঠোফোনটি ধ্বংস করে ফেলেন খুনিরা। সেটি থেকেও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। পরে মামুন মেসেঞ্জার ব্যবহার করেন কি না, সেটি সামনে রেখে তদন্ত শুরু করা হয়।

মামুন ও নজরুলের কথোপকথন বিশ্লেষণ করে পিবিআইয়ের সন্দেহ হয় যে নজরুল ও তাঁর বন্ধুরা মামুনকে খুন করে থাকতে পারেন। এই সন্দেহ থেকে একে একে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের তথ্যে ও আদালতে এক আসামির জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত বেরিয়ে আসে।

পিবিআই বলছে, একপর্যায়ে মামুনের মেসেঞ্জার সচল পাওয়া যায়। তখন তাদের ধারণা হয়, এতে কারও সঙ্গে কথোপকথনের সূত্র থাকতে থাকতে পারে। মেসেঞ্জার ঘেঁটে পিবিআই দেখতে পায়, মামুনকে হত্যার আগের কয়েক দিন তাঁর বন্ধু নজরুল ইসলাম ওরফে সুজন (২২) তাঁকে (মামুন) হুমকি দিয়েছেন। মামুনও নজরুলকে পাল্টা হুমকি দিয়েছেন।

পাল্টাপাল্টি হুমকির কারণ কী, তা জানতে চাইলে পিবিআইয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, মাদক বিক্রির টাকা আত্মসাৎ করা নিয়ে দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। নজরুলের বাড়ি কক্সবাজারের উখিয়ায়। তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি উখিয়া থেকে ইয়াবা বড়ি এনে বন্ধুদের দিতেন বিক্রির জন্য। মামুন ইয়াবা বিক্রির টাকা আত্মসাৎ করেছিলেন।

মামুন ও নজরুলের কথোপকথন বিশ্লেষণ করে পিবিআইয়ের সন্দেহ হয় যে নজরুল ও তাঁর বন্ধুরা মামুনকে খুন করে থাকতে পারেন। এই সন্দেহ থেকে একে একে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের তথ্যে ও আদালতে এক আসামির জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত বেরিয়ে আসে।

২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর গাজীপুরে অভিযান চালিয়ে প্রথমে গ্রেপ্তার করা হয় মামুনের বন্ধু সৈয়দ নাকিব ইকবাল ওরফে নীলয় (২৩) ও মেরাজ হোসেনকে (২৩)। নাকিব ইকবাল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাঁর তথ্যের ভিত্তিতে গত বছরের ২০ ডিসেম্বর নজরুলকে এবং পরে নজরুলের তথ্যে তাঁর বন্ধু ইমাম হোসেন ওরফে হৃদয় ওরফে শুভ (২৫) ও শাওন মাহমুদকে (২৪) গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তার পাঁচ আসামি এখন কারাগারে। তাঁদের মধ্যে নজরুল, নাকিব ও মেরাজ খুন হওয়া মামুনের সঙ্গে গাজীপুরের কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে পড়তেন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৮ সালের ১২ মার্চ তাঁরা ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে মামুনকে সঙ্গে নিয়ে গাজীপুরের শিমুলতলী থেকে বাসে জয়দেবপুরের শিববাড়িতে নিয়ে যান। মামুনের বন্ধুদের ব্যাগে ছিল চাকু, গাঁজা, ঘুমের ওষুধ ও কোমল পানীয়।

খুনের ছক
খুনের সঙ্গে জড়িত ইমাম নিহত মামুনের এক বান্ধবীকে পছন্দ করতেন। এ নিয়ে ইমামের সঙ্গে মামুনের দ্বন্দ্ব চলছিল। পিবিআইয়ের কর্মকর্তারা জানান, এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নজরুল তাঁর বন্ধু ইমাম, নাকিব, মেরাজ ও শাওনকে নিয়ে মামুনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। প্রত্যেককে ১০ হাজার করে টাকা দেন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৮ সালের ১২ মার্চ তাঁরা ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে মামুনকে সঙ্গে নিয়ে গাজীপুরের শিমুলতলী থেকে বাসে জয়দেবপুরের শিববাড়িতে নিয়ে যান। মামুনের বন্ধুদের ব্যাগে ছিল চাকু, গাঁজা, ঘুমের ওষুধ ও কোমল পানীয়।

মামুনকে নিয়ে খুনিরা দক্ষিণখানের বাইপাস সড়কসংলগ্ন দিঘির দক্ষিণ পাশের জমিতে বসে আড্ডা দেন। একপর্যায়ে কোমল পানীয়র সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে মামুনকে খাইয়ে দেওয়া হয়। মামুন ঘুমিয়ে গেলে রাত ১০টার দিকে তাঁকে খুন করা হয়।

পিবিআই বলছে, খুনের আগে মামুন স্কুলব্যাগে মাথা রেখে শুয়ে ধূমপান করছেন—এমন ছবি তুলে মেসেঞ্জারে তাঁর (মামুন) বান্ধবীকে পাঠান ইমাম, যাতে মামুনের সঙ্গে তাঁর বান্ধবীর সম্পর্কের অবনতি হয়।

খুনের পর খুনিরা অটোরিকশায় করে জয়দেবপুর স্টেশনে যান। সেখান থেকে যে যাঁর মতো চলে যান।

পুলিশ পরিদর্শক হাফিজুর রহমান বলেন, হত্যার আগে যে স্কুলব্যাগের ওপর মামুন মাথা রেখে শুয়ে ছিলেন, সেটি আসামি শাওন মাহমুদের বাসা থেকে এবং হত্যায় ব্যবহৃত ছুরিটি ইমাম হোসেনের বাসার বিছানার নিচ থেকে জব্দ করা হয়েছে।

মামুনের বাসায় খুনির দুপুরের খাবার
মামুনের বাড়ি গাজীপুরের কালিয়াকৈরে সফিপুরে। তবে বাবার চাকরি সূত্রে তাঁরা গাজীপুর শহরে ভাড়া থাকতেন। মামুনের বাবা জালালউদ্দিন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারি শিশু পরিবারের হিসাবরক্ষক। মামুন গাজীপুরের কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় ছিলেন।

মামুনের বাবা জালালউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ছেলে নিখোঁজের পর তিনি তাঁকে খুঁজতে বের হন। তখন মামুনের বন্ধু নাকিবও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি, নাকিব তাঁর ছেলের খুনি। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের আগের দিন নাকিব তাঁদের বাসায় দুপুরের খাবার খেয়েছিলেন।

জালালউদ্দিন আরও বলেন, পিবিআইয়ের তদন্তে তিনি সন্তুষ্ট। এখন হত্যাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি চান।

থানা-পুলিশ কেন পারে না
২০১৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর মামুন হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিলেন গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) গাজীপুর সদর থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) মো. ইমতিয়াজুর রহমান। আজ মঙ্গলবার বিকেলে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরাও চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পিবিআইয়ের কাছে হাই টেকনোলজি (উচ্চ প্রযুক্তি) রয়েছে। তাদের আইটি টেকনোলজির নলেজও (তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান) বেশি।’

ইমতিয়াজুর বলেন, থানা-পুলিশকে নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। থানা-পুলিশের চেয়ে পিবিআই নিবিড় তদন্ত করতে পর্যাপ্ত সময় পায়। পিবিআইয়ের কাজ শুধু মামলা তদন্ত করা। সবকিছু ঢেলে সাজিয়ে পিবিআই যেমন ভাবে তদন্ত করতে পেরেছে, থানা-পুলিশ করতে পারেনি।

মুহাম্মদ উমর ফারুক
মুহাম্মদ উমর ফারুক

থানা-পুলিশের ওপর প্রভাব বিস্তার করা বা হস্তক্ষেপ করার অনেক উদাহরণ রয়েছে। এ কারণে তারা পেশাদারির সঙ্গে সব সময় তদন্ত করে না বা করতে পারে না।

মুহাম্মদ উমর ফারুক, অধ্যাপক, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, খুনের মামলার রহস্য উদ্‌ঘাটনে থানা-পুলিশ সফল হয়নি। কিন্তু পিবিআই রহস্য উদ্‌ঘাটন করেছে।

বিষয়টি নিয়ে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, পিবিআই তদন্তের ক্ষেত্রে অনেকটাই স্বাধীন। এ কারণে প্রভাব বা অন্য কারও হস্তক্ষেপ কম থাকে। তাই তারা স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করতে পারে। তদন্তে তাদের সফলতাও অনেক বেশি।

উমর ফারুক আরও বলেন, থানা-পুলিশের ওপর প্রভাব বিস্তার করা বা হস্তক্ষেপ করার অনেক উদাহরণ রয়েছে। এ কারণে তারা পেশাদারির সঙ্গে সব সময় তদন্ত করে না বা করতে পারে না।

বিষয়

বেওয়ারিশ লাশ, মেসেঞ্জার বার্তা ও একটি খুনের রহস্য উদ্‌ঘাটন

প্রকাশিত: ০২:০৪:১১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩

২০১৮ সালের একটি খুনের মামলার রহস্য উদ্‌ঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। খুনিরা ধরা পড়েছেন ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম মেসেঞ্জার বার্তার সূত্র ধরে।

খুন হয়েছিলেন গাজীপুরের কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ছাত্র আবদুল্লাহ আল মামুন (১৮)। তাঁর বন্ধুরা তাঁকে গলা কেটে হত্যা করেন। তাঁর লাশ দাফন হয়েছিল বেওয়ারিশ হিসেবে।

অবশ্য পরে মামুনের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু গাজীপুর থানার পুলিশ খুনের রহস্যের কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি। অবশেষে পিবিআই খুনের রহস্য বের করে সম্প্রতি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে।

মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র ও তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের ১৩ মার্চ গাজীপুরের জয়দেবপুর থানার দক্ষিণখান বাইপাস-সংলগ্ন দিঘির দক্ষিণ পাশের এক জায়গা থেকে মানুষের বিচ্ছিন্ন একটি মাথা ও কাছের আরেক জায়গায় ক্ষতবিক্ষত একটি লাশ উদ্ধার করা হয়। সেটি কিছুদিন গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের মর্গে পড়ে ছিল। লাশটি কেউ শনাক্ত করেনি, দাবিও করেনি।

পরে লাশটি বেওয়ারিশ হিসেবে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কবরস্থানে দাফন করা হয়। আর পুলিশের এক উপপরিদর্শক (এসআই) বাদী হয়ে অজ্ঞাত তরুণ খুনের ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে জয়দেবপুর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।

একই সময় নিহত মামুনের বাবা তাঁর ছেলে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় জয়দেবপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন। ওই জিডির সূত্রে কবর থেকে মামুনের লাশ তোলা হয়। পরে স্বজনেরা তাঁর লাশ শনাক্ত করেন।

মামুন হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্‌ঘাটনের কোনো সূত্র ছিল না। পিবিআই তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর তাঁরা মামুনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু হত্যার উদ্দেশ্য বা অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে মামুনের পরিবার কোনো তথ্য দিতে পারেনি।

মো. হাফিজুর রহমান, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা

লাশ উদ্ধারের ঘটনাস্থল গাজীপুর মহানগর এলাকায় হওয়ায় মামুন হত্যা মামলার তদন্তভার জয়দেবপুর থানা থেকে গাজীপুর সদর থানায় স্থানান্তর করা হয়। দেড় বছর পর ২০১৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর গাজীপুর সদর থানার পুলিশ হত্যাকারীদের শনাক্ত করতে না পেরে মামলাটিতে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। ২০২০ সালের ১৮ মার্চ আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই গাজীপুরের পরিদর্শক মো. হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মামুন হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্‌ঘাটনের কোনো সূত্র ছিল না। পিবিআই তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর তাঁরা মামুনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু হত্যার উদ্দেশ্য বা অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে মামুনের পরিবার কোনো তথ্য দিতে পারেনি।

হাফিজুর রহমান আরও বলেন, মামুনকে হত্যার পর তাঁর মুঠোফোনটি ধ্বংস করে ফেলেন খুনিরা। সেটি থেকেও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। পরে মামুন মেসেঞ্জার ব্যবহার করেন কি না, সেটি সামনে রেখে তদন্ত শুরু করা হয়।

মামুন ও নজরুলের কথোপকথন বিশ্লেষণ করে পিবিআইয়ের সন্দেহ হয় যে নজরুল ও তাঁর বন্ধুরা মামুনকে খুন করে থাকতে পারেন। এই সন্দেহ থেকে একে একে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের তথ্যে ও আদালতে এক আসামির জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত বেরিয়ে আসে।

পিবিআই বলছে, একপর্যায়ে মামুনের মেসেঞ্জার সচল পাওয়া যায়। তখন তাদের ধারণা হয়, এতে কারও সঙ্গে কথোপকথনের সূত্র থাকতে থাকতে পারে। মেসেঞ্জার ঘেঁটে পিবিআই দেখতে পায়, মামুনকে হত্যার আগের কয়েক দিন তাঁর বন্ধু নজরুল ইসলাম ওরফে সুজন (২২) তাঁকে (মামুন) হুমকি দিয়েছেন। মামুনও নজরুলকে পাল্টা হুমকি দিয়েছেন।

পাল্টাপাল্টি হুমকির কারণ কী, তা জানতে চাইলে পিবিআইয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, মাদক বিক্রির টাকা আত্মসাৎ করা নিয়ে দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। নজরুলের বাড়ি কক্সবাজারের উখিয়ায়। তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি উখিয়া থেকে ইয়াবা বড়ি এনে বন্ধুদের দিতেন বিক্রির জন্য। মামুন ইয়াবা বিক্রির টাকা আত্মসাৎ করেছিলেন।

মামুন ও নজরুলের কথোপকথন বিশ্লেষণ করে পিবিআইয়ের সন্দেহ হয় যে নজরুল ও তাঁর বন্ধুরা মামুনকে খুন করে থাকতে পারেন। এই সন্দেহ থেকে একে একে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের তথ্যে ও আদালতে এক আসামির জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত বেরিয়ে আসে।

২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর গাজীপুরে অভিযান চালিয়ে প্রথমে গ্রেপ্তার করা হয় মামুনের বন্ধু সৈয়দ নাকিব ইকবাল ওরফে নীলয় (২৩) ও মেরাজ হোসেনকে (২৩)। নাকিব ইকবাল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাঁর তথ্যের ভিত্তিতে গত বছরের ২০ ডিসেম্বর নজরুলকে এবং পরে নজরুলের তথ্যে তাঁর বন্ধু ইমাম হোসেন ওরফে হৃদয় ওরফে শুভ (২৫) ও শাওন মাহমুদকে (২৪) গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তার পাঁচ আসামি এখন কারাগারে। তাঁদের মধ্যে নজরুল, নাকিব ও মেরাজ খুন হওয়া মামুনের সঙ্গে গাজীপুরের কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে পড়তেন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৮ সালের ১২ মার্চ তাঁরা ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে মামুনকে সঙ্গে নিয়ে গাজীপুরের শিমুলতলী থেকে বাসে জয়দেবপুরের শিববাড়িতে নিয়ে যান। মামুনের বন্ধুদের ব্যাগে ছিল চাকু, গাঁজা, ঘুমের ওষুধ ও কোমল পানীয়।

খুনের ছক
খুনের সঙ্গে জড়িত ইমাম নিহত মামুনের এক বান্ধবীকে পছন্দ করতেন। এ নিয়ে ইমামের সঙ্গে মামুনের দ্বন্দ্ব চলছিল। পিবিআইয়ের কর্মকর্তারা জানান, এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নজরুল তাঁর বন্ধু ইমাম, নাকিব, মেরাজ ও শাওনকে নিয়ে মামুনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। প্রত্যেককে ১০ হাজার করে টাকা দেন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৮ সালের ১২ মার্চ তাঁরা ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে মামুনকে সঙ্গে নিয়ে গাজীপুরের শিমুলতলী থেকে বাসে জয়দেবপুরের শিববাড়িতে নিয়ে যান। মামুনের বন্ধুদের ব্যাগে ছিল চাকু, গাঁজা, ঘুমের ওষুধ ও কোমল পানীয়।

মামুনকে নিয়ে খুনিরা দক্ষিণখানের বাইপাস সড়কসংলগ্ন দিঘির দক্ষিণ পাশের জমিতে বসে আড্ডা দেন। একপর্যায়ে কোমল পানীয়র সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে মামুনকে খাইয়ে দেওয়া হয়। মামুন ঘুমিয়ে গেলে রাত ১০টার দিকে তাঁকে খুন করা হয়।

পিবিআই বলছে, খুনের আগে মামুন স্কুলব্যাগে মাথা রেখে শুয়ে ধূমপান করছেন—এমন ছবি তুলে মেসেঞ্জারে তাঁর (মামুন) বান্ধবীকে পাঠান ইমাম, যাতে মামুনের সঙ্গে তাঁর বান্ধবীর সম্পর্কের অবনতি হয়।

খুনের পর খুনিরা অটোরিকশায় করে জয়দেবপুর স্টেশনে যান। সেখান থেকে যে যাঁর মতো চলে যান।

পুলিশ পরিদর্শক হাফিজুর রহমান বলেন, হত্যার আগে যে স্কুলব্যাগের ওপর মামুন মাথা রেখে শুয়ে ছিলেন, সেটি আসামি শাওন মাহমুদের বাসা থেকে এবং হত্যায় ব্যবহৃত ছুরিটি ইমাম হোসেনের বাসার বিছানার নিচ থেকে জব্দ করা হয়েছে।

মামুনের বাসায় খুনির দুপুরের খাবার
মামুনের বাড়ি গাজীপুরের কালিয়াকৈরে সফিপুরে। তবে বাবার চাকরি সূত্রে তাঁরা গাজীপুর শহরে ভাড়া থাকতেন। মামুনের বাবা জালালউদ্দিন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারি শিশু পরিবারের হিসাবরক্ষক। মামুন গাজীপুরের কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় ছিলেন।

মামুনের বাবা জালালউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ছেলে নিখোঁজের পর তিনি তাঁকে খুঁজতে বের হন। তখন মামুনের বন্ধু নাকিবও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি, নাকিব তাঁর ছেলের খুনি। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের আগের দিন নাকিব তাঁদের বাসায় দুপুরের খাবার খেয়েছিলেন।

জালালউদ্দিন আরও বলেন, পিবিআইয়ের তদন্তে তিনি সন্তুষ্ট। এখন হত্যাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি চান।

থানা-পুলিশ কেন পারে না
২০১৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর মামুন হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিলেন গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) গাজীপুর সদর থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) মো. ইমতিয়াজুর রহমান। আজ মঙ্গলবার বিকেলে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরাও চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পিবিআইয়ের কাছে হাই টেকনোলজি (উচ্চ প্রযুক্তি) রয়েছে। তাদের আইটি টেকনোলজির নলেজও (তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান) বেশি।’

ইমতিয়াজুর বলেন, থানা-পুলিশকে নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। থানা-পুলিশের চেয়ে পিবিআই নিবিড় তদন্ত করতে পর্যাপ্ত সময় পায়। পিবিআইয়ের কাজ শুধু মামলা তদন্ত করা। সবকিছু ঢেলে সাজিয়ে পিবিআই যেমন ভাবে তদন্ত করতে পেরেছে, থানা-পুলিশ করতে পারেনি।

মুহাম্মদ উমর ফারুক
মুহাম্মদ উমর ফারুক

থানা-পুলিশের ওপর প্রভাব বিস্তার করা বা হস্তক্ষেপ করার অনেক উদাহরণ রয়েছে। এ কারণে তারা পেশাদারির সঙ্গে সব সময় তদন্ত করে না বা করতে পারে না।

মুহাম্মদ উমর ফারুক, অধ্যাপক, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, খুনের মামলার রহস্য উদ্‌ঘাটনে থানা-পুলিশ সফল হয়নি। কিন্তু পিবিআই রহস্য উদ্‌ঘাটন করেছে।

বিষয়টি নিয়ে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, পিবিআই তদন্তের ক্ষেত্রে অনেকটাই স্বাধীন। এ কারণে প্রভাব বা অন্য কারও হস্তক্ষেপ কম থাকে। তাই তারা স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করতে পারে। তদন্তে তাদের সফলতাও অনেক বেশি।

উমর ফারুক আরও বলেন, থানা-পুলিশের ওপর প্রভাব বিস্তার করা বা হস্তক্ষেপ করার অনেক উদাহরণ রয়েছে। এ কারণে তারা পেশাদারির সঙ্গে সব সময় তদন্ত করে না বা করতে পারে না।