চারিদিকে থৈ থৈ করছে পানি। কোথাও হাঁটু সমান কোথাও কোমর আবার কোথাও বুক সমান পানি। তিল ধারণের ঠাঁই নেই আশ্রয়ণ কেন্দ্রে। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। আশ্রয়কেন্দ্রে গবাদিপশুর সঙ্গে গদাগদি করে থাকছেন বন্যায় আক্রান্ত মানুষ। গত সোমবার থেকে সিলেটে দ্বিতীয় দফা বন্যা দেখা দিয়েছে। এর আগে গত ২৯ মে সিলেটে বন্যা হয়েছিল, সেটি ৮ জুনের পর অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে যায়। এর রেশ না কাটতেই ফের বন্যার কবলে পড়েছে সিলেট।
নগরের যতরপুর এলাকার বাসিন্দা ফরিদ মিয়া জানান, গত সোমবার রাত থেকে পানি বাড়তে শুরু করে। আধাঘন্টার মধ্যেই তার বসত ভিটায় পানি ঢুকে পড়ে। হাঁটুসমান পানি নিয়েই কোনমতে রাত পার করেন। সকালে আর ঘরে ঠিকতে পারেন নি। বুক সমান পানি সাতরে পরিবার পরিজন নিয়ে আশ্রয়ণ কেন্দ্রে ঠাঁই নেন তিনি।
আজ সকালে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার তেলিখাল উচ্চ বিদ্যালয়ে গেলে দেখা গেছে, এই আশ্রয়কেন্দ্রে আশপাশের প্লাবিত বিভিন্ন গ্রামের লোকজন পরিবার পরিজন নিয়ে সেখানে উঠছেন। বস্তায় কাপড়চোপড়, কাঁথা-বালিশ, রান্নার বাসন ভরে নিয়ে এসেছেন। কেউ কেউ সঙ্গে নিয়ে আসা হাঁস, মোরগ ও ছাগল বারান্দার খুঁটিতে বেঁধে রেখেছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে বেঞ্চ জোড়া দিয়ে খাট তৈরি করা হয়েছে। বারান্দায় মাটির চুলা বসিয়ে কেউ কেউ রান্নার আয়োজন করেছেন।
আশ্রয়কেন্দ্রের সামনে কথা হয় সফতেরা বিবির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সকালে উঠানে পানি আছিল। আস্তে আস্তে ঘরো উঠা আরম্ভ করল (করে)। কোনোমতে রাইত (রাত) খাটাইছি। সকালে পানি বাড়ায় আর টিকা (থাকা) গেছে না। জান বাঁচাইবার লাগি আইয়া ইশকুলু (স্কুলে) উঠছি।’
কানাইঘাট উপজেলার একটি আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে দেখা গেছে, একটি কক্ষে ১০ থেকে ১২ জন মানুষ গদাগদি করে এখানে থাকছেন। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন হাঁস-মোরগ। সাংবাদিক এসেছেন শুনে দৌড়ে এলেন এক গৃহীনি। কোলে দুধের শিশু; চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। কথা হলে অশ্রুভেজা কন্ঠে তিনি জানান, দুইদিন ধরে শুকনো খাবার খাচ্ছি। আর পারছিনা। সন্তানেরা শুকনো খাবার খেতে চাচ্ছেনা। সঙ্গে সামান্য চাল-ডাল নিয়ে এসেছিলাম সেগুলোও শেষ। এখন কি খাবো, কীভাবে বাঁচবো।
জৈন্তাপুর উপজেলার একটি আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, তিল ধারণের ঠাঁই নেই। দুইতলা বিশিষ্ট স্কুলের পুরোটাই মানুষে ঠাসা। একটি কক্ষে ছয় থেকে সাত পরিবারের সদস্যারা থাকছেন এখানে। অনেকে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেতে বারান্দায় মেঝেতে থাকছেন। নীচের একটি কক্ষে গবাদি পশু বেঁধে রাখা হয়েছে। সেই কক্ষেও কয়েকজন আশ্রয় নিয়েছেন।
বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে সিলেট মহানগরেও। এরই মধ্যে নগরের ২৩টি ওয়ার্ড তলিয়ে গেছে। আনুমানিক ১ লাখ মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেনে বলে জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে।
পাউবোর তথ্যমতে, বুধবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত জেলার তিনিটি নদ-নদীর পানি বিপৎসীর ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এর মধ্যে সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৯৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এক পানি সিলেট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। আর কুশিয়ারা নদীর আমলশীদ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৬২ সেন্টিমিটার ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ১০০ ও শেরপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার ২১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এছাড়া সারি-গোয়াইন নদীর সারিঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ০.২ সে.মি সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
সিলেট জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বুধবার পর্যন্ত সিলেট মহানগরীর ২৩টি ওয়ার্ডসহ জেলার ১২৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার ১ হাজার ৫৪৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ৮ লাখ ২৫ হাজার ২৫৬ জন বন্যা আক্রান্ত রয়েছেন। এর মধ্যে সিলেট মহানগরীতে বন্যাক্রান্ত হয়েছেন ৫০ হাজার মানুষ। জেলা ও মহানগর মিলিয়ে ৬৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ১৯ হাজার ৯৪৯ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
এদিকে বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শনে বুধবার সিলেট এসেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মুহিবুল ইসলাম। তিনি দুপুর আড়াইটার দিকে নগরীর মিরাবাজারের কিশোরী মোহন বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের অধশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন ও বন্যাক্রান্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেন।
সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন বলেন, ‘সিলেটে যে বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে তা আরও পাঁচদিন অব্যাহত থাকতে পারে। তাই সবাইকে সাবধান থাকতে হবে।’