১১:০০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সংকটে যেভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে শ্রীলঙ্কা

দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। দেশটির বিদেশি মুদ্রা আয়ের মূল খাত পর্যটন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। সেই সঙ্গে দেশটির সরকার ব্যয় কমিয়ে রাজস্ব আয় বাড়ানো ও সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। সব মিলিয়ে ২০২২ সালের এই সময়ে দেশটির যে অবস্থা ছিল, পরিস্থিতি এখন তার চেয়ে অনেক ভালো বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

গত বছর চরম বিপর্যয়ের মুখে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ৭ দশমিক ৮ শতাংশ সংকুচিত হয়। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো অবশ্য বলছে, এ বছরও দেশটির জিডিপি সংকুচিত হবে, তবে সংকোচনের হার কমে আসবে। আর আগামী বছর প্রবৃদ্ধি হবে।

আরও পড়ুন

শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি যেভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল

বৈদেশিক মুদ্রাসংকটের কারণে শ্রীলঙ্কায় নিত্যপণ্যের ভয়াবহ সংকট দেখা দেয়

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ঠিক পথেই আছে, প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো কাজ করছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের যেসব শর্ত পরিপালনের কথা বলে তারা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ পেয়েছে, সেসব শর্তও তারা অন্যান্য সমগোত্রীয় দেশের তুলনায় ভালোভাবে পরিপালন করতে পারছে।

এক বছর আগে অর্থনৈতিক সংকটে রীতিমতো অচল হয়ে পড়েছিল শ্রীলঙ্কা—প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশ ছুঁয়ে যায়, জ্বালানিসংকট চরমে পৌঁছায়, আর পেট্রলপাম্পগুলোতে অপেক্ষমাণ যানবাহনের সারি কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়।

অর্থনৈতিক সংকটের জেরে শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালের মার্চে শুরু হয় বিক্ষোভ। কয়েক মাস ধরে চলা বিক্ষোভে পতন হয় রাজাপক্ষে সরকারের।বিক্ষোভকারীদের এ ছবি গত বছরের ৯ জুলাই প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের সামনের
অর্থনৈতিক সংকটের জেরে শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালের মার্চে শুরু হয় বিক্ষোভ। কয়েক মাস ধরে চলা বিক্ষোভে পতন হয় রাজাপক্ষে সরকারের।বিক্ষোভকারীদের এ ছবি গত বছরের ৯ জুলাই প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের সামনেরছবি: রয়টার্স

অনেকেই এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার তুলনা করেন। ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক সম্পাদকীয়তে সম্প্রতি বলা হয়েছে, পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের চেয়ে শ্রীলঙ্কা অনেক ভালো করছে। সেখানে বলা হয়েছে, দুই দেশের মধ্যকার মূল পার্থক্য হলো, শ্রীলঙ্কার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো পাকিস্তানের চেয়ে অনেক শক্তিশালী।

এক বছর আগে অর্থনৈতিক সংকটে রীতিমতো অচল হয়ে পড়েছিল শ্রীলঙ্কা—প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশ ছুঁয়ে যায়, জ্বালানিসংকট চরমে পৌঁছায়, আর পেট্রলপাম্পগুলোতে অপেক্ষমাণ যানবাহনের সারি কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। জন–অসন্তোষ চরমে ওঠে। গণরোষের মুখে পড়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। এরপর দায়িত্ব নেন রানিল বিক্রমাসিংহে।

গত বছরের সেই দৃশ্য আর চোখে পড়ে না। রানিল বিক্রমাসিংহে এখন পর্যন্ত দেশকে ঠিক পথেই নিয়ে যাচ্ছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

আরও পড়ুন

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শ্রীলঙ্কার সাফল্য, নেমেছে এক অঙ্কের ঘরে

গত বছর শ্রীলঙ্কা ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক দুর্দশার মুখে পড়ে। কয়েক মাস ধরে চলে খাবার, জ্বালানি ও ওষুধের তীব্র সংকট।

যেভাবে পরিবর্তনের পথে

বিবিসির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কার সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু নীতিগত পদক্ষেপের কারণে দেশটিতে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। প্রবাসী আয় ও পর্যটনের মতো কিছু খাত একরকম ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ফলে উন্নতি ঘটেছে সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির।

গত বছর জ্বালানি ও রান্নার তেলসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যে স্বল্পতা ছিল, সেটা এখন নেই। মূল্যস্ফীতির হার অনেকটাই কমেছে। এই সবকিছুই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের অংশ। বাস্তবতা হলো, পরিস্থিতি গত বছর যতটা খারাপ ছিল, এ বছর ততটা নয়।

শ্রীলঙ্কার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাক্রোইকোন রিস্ক অ্যান্ড ফ্রন্টিয়ার রিসার্চের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ঝুঁকি বিভাগের প্রধান ছায়ু দামাসিংহে

আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, শ্রীলঙ্কা সরকার ব্যয় কমিয়ে রাজস্ব বাড়িয়েছে আর সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করে করজাল বিস্তৃত করেছে—মূলত এই দুটি নীতি পদক্ষেপের কারণে ঘুরতে শুরু করেছে দেশটির অর্থনীতির চাকা। তবে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, দেশটিকে এখনো লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে।

এ বিষয়ে শ্রীলঙ্কার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাক্রোইকোন রিস্ক অ্যান্ড ফ্রন্টিয়ার রিসার্চের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ঝুঁকি বিভাগের প্রধান ছায়ু দামাসিংহে বলেন, গত বছর জ্বালানি ও রান্নার তেলসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যে স্বল্পতা ছিল, সেটা এখন নেই। মূল্যস্ফীতির হার অনেকটাই কমেছে। এই সবকিছুই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের অংশ। বাস্তবতা হলো, পরিস্থিতি গত বছর যতটা খারাপ ছিল, এ বছর ততটা নয়।

নতুন গভর্নর আসার পর সরকার তাঁকে স্বাধীনভাবে দুটি কাজ করার সুযোগ দেয়। মূলত যে দুটি খাতে তিনি হাত দেন তাহলো, নীতি সুদহার বৃদ্ধি ও মুদ্রার একক বিনিময় হার নিশ্চিত করা। অন্যান্য দেশের মতো শ্রীলঙ্কায়ও মুদ্রার অনানুষ্ঠানিক বাজার আছে, সেখানকার কারসাজির কারণেও মুদ্রার বিনিময় হারে প্রভাব পড়ে, মূল্যস্ফীতি বাড়ে।

শ্রীলঙ্কা  ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক দুর্দশার মুখে পড়েছে। কয়েক মাস ধরে খাবার, জ্বালানি ও ওষুধের তীব্র সংকট চলছে
শ্রীলঙ্কা ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক দুর্দশার মুখে পড়েছে। কয়েক মাস ধরে খাবার, জ্বালানি ও ওষুধের তীব্র সংকট চলছেরয়টার্স ফাইল ছবি

আরেকটি বিষয় হলো, যে কারণে গত বছর এ রকম সংকট হলো, সেটা আমলে নেওয়া। সংকটের মূল কারণ ছিল বাজেট ও বহিঃস্থ অর্থনীতির ঘাটতি, যে কারণে ঋণসংকট তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। ঋণসংকট মোকাবিলায় এই দুই প্রতিষ্ঠান ঋণ পুনর্গঠন করছে। এ ছাড়া সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে নতুন কর আইন করাসহ করহার বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং ব্যয় সংকোচন করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

আইএমএফের শর্ত মেনে শ্রীলঙ্কার ঋণ পুনর্গঠনের চেষ্টা

চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কী করা হয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে ছায়ু দামাসিংহে বলেন, মূল্যস্ফীতির একটি কারণ ছিল দেশ থেকে অর্থ বেরিয়ে যাওয়া। সেটা হতো মূলত আমদানির মাধ্যমে, যার মূল্য পরিশোধ করতে হতো ডলারে। ডলার বেরিয়ে গেলে স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় মূল্য কমে যায়, যে কারণে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে।

২০২২ সালে দেশটির ৩ লাখ ১১ হাজারের বেশি মানুষ কাজের জন্য বিদেশে গেছেন, যাঁদের মধ্যে চিকিৎসক, প্যারামেডিকেল, তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের মতো অনেক উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী আছেন।

নতুন গভর্নর আসার পর সরকার তাঁকে স্বাধীনভাবে দুটি কাজ করার সুযোগ দেয়। মূলত যে দুটি খাতে তিনি হাত দেন তাহলো, নীতি সুদহার বৃদ্ধি ও মুদ্রার একক বিনিময় হার নিশ্চিত করা। অন্যান্য দেশের মতো শ্রীলঙ্কায়ও মুদ্রার অনানুষ্ঠানিক বাজার আছে, সেখানকার কারসাজির কারণেও মুদ্রার বিনিময় হারে প্রভাব পড়ে, মূল্যস্ফীতি বাড়ে। তবে মুদ্রার বিনিময় হারের ওঠানামা করলেও নীতি সুদহার বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরা গেছে।

শ্রীলঙ্কার সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের জুলাই মাসে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। এ সময়ে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি কমেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে সংকটের চূড়ান্ত সময়ে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৪৯ শতাংশের বেশি।

আরেকটি খাতে শ্রীলঙ্কা গত এক বছরে অনেক ভালো করেছে। সেটা হলো শ্রমশক্তি রপ্তানি। বস্তুত গত বছর বিদেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে দেশটি। ২০২২ সালে দেশটির ৩ লাখ ১১ হাজারের বেশি মানুষ কাজের জন্য বিদেশে গেছেন, যাঁদের মধ্যে চিকিৎসক, প্যারামেডিকেল, তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের মতো অনেক উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী আছেন। এঁরা বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় পাঠানোর কারণে গত এক বছরে দেশটির প্রবাসী আয় ৭৬ শতাংশ বেড়েছে।

তবে আইএমএফের ঋণের সঙ্গে নানা ধরনের শর্ত থাকে। এসব শর্ত পূরণ করা সাপেক্ষেই ঋণ দেওয়া হয়। এতে অনেক দেশ উপকৃত হয়, আবার অনেক দেশ বিপদে পড়ে। তবে শ্রীলঙ্কা এবার আইএমএফের ঋণের বেশির ভাগ শর্ত ভালোভাবেই পূরণ করতে পেরেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

বিষয়

সংকটে যেভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে শ্রীলঙ্কা

প্রকাশিত: ০৬:৪৯:৩৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩

দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। দেশটির বিদেশি মুদ্রা আয়ের মূল খাত পর্যটন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। সেই সঙ্গে দেশটির সরকার ব্যয় কমিয়ে রাজস্ব আয় বাড়ানো ও সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। সব মিলিয়ে ২০২২ সালের এই সময়ে দেশটির যে অবস্থা ছিল, পরিস্থিতি এখন তার চেয়ে অনেক ভালো বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

গত বছর চরম বিপর্যয়ের মুখে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ৭ দশমিক ৮ শতাংশ সংকুচিত হয়। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো অবশ্য বলছে, এ বছরও দেশটির জিডিপি সংকুচিত হবে, তবে সংকোচনের হার কমে আসবে। আর আগামী বছর প্রবৃদ্ধি হবে।

আরও পড়ুন

শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি যেভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল

বৈদেশিক মুদ্রাসংকটের কারণে শ্রীলঙ্কায় নিত্যপণ্যের ভয়াবহ সংকট দেখা দেয়

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ঠিক পথেই আছে, প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো কাজ করছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের যেসব শর্ত পরিপালনের কথা বলে তারা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ পেয়েছে, সেসব শর্তও তারা অন্যান্য সমগোত্রীয় দেশের তুলনায় ভালোভাবে পরিপালন করতে পারছে।

এক বছর আগে অর্থনৈতিক সংকটে রীতিমতো অচল হয়ে পড়েছিল শ্রীলঙ্কা—প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশ ছুঁয়ে যায়, জ্বালানিসংকট চরমে পৌঁছায়, আর পেট্রলপাম্পগুলোতে অপেক্ষমাণ যানবাহনের সারি কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়।

অর্থনৈতিক সংকটের জেরে শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালের মার্চে শুরু হয় বিক্ষোভ। কয়েক মাস ধরে চলা বিক্ষোভে পতন হয় রাজাপক্ষে সরকারের।বিক্ষোভকারীদের এ ছবি গত বছরের ৯ জুলাই প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের সামনের
অর্থনৈতিক সংকটের জেরে শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালের মার্চে শুরু হয় বিক্ষোভ। কয়েক মাস ধরে চলা বিক্ষোভে পতন হয় রাজাপক্ষে সরকারের।বিক্ষোভকারীদের এ ছবি গত বছরের ৯ জুলাই প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের সামনেরছবি: রয়টার্স

অনেকেই এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার তুলনা করেন। ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক সম্পাদকীয়তে সম্প্রতি বলা হয়েছে, পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের চেয়ে শ্রীলঙ্কা অনেক ভালো করছে। সেখানে বলা হয়েছে, দুই দেশের মধ্যকার মূল পার্থক্য হলো, শ্রীলঙ্কার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো পাকিস্তানের চেয়ে অনেক শক্তিশালী।

এক বছর আগে অর্থনৈতিক সংকটে রীতিমতো অচল হয়ে পড়েছিল শ্রীলঙ্কা—প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশ ছুঁয়ে যায়, জ্বালানিসংকট চরমে পৌঁছায়, আর পেট্রলপাম্পগুলোতে অপেক্ষমাণ যানবাহনের সারি কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। জন–অসন্তোষ চরমে ওঠে। গণরোষের মুখে পড়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। এরপর দায়িত্ব নেন রানিল বিক্রমাসিংহে।

গত বছরের সেই দৃশ্য আর চোখে পড়ে না। রানিল বিক্রমাসিংহে এখন পর্যন্ত দেশকে ঠিক পথেই নিয়ে যাচ্ছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

আরও পড়ুন

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শ্রীলঙ্কার সাফল্য, নেমেছে এক অঙ্কের ঘরে

গত বছর শ্রীলঙ্কা ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক দুর্দশার মুখে পড়ে। কয়েক মাস ধরে চলে খাবার, জ্বালানি ও ওষুধের তীব্র সংকট।

যেভাবে পরিবর্তনের পথে

বিবিসির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কার সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু নীতিগত পদক্ষেপের কারণে দেশটিতে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। প্রবাসী আয় ও পর্যটনের মতো কিছু খাত একরকম ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ফলে উন্নতি ঘটেছে সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির।

গত বছর জ্বালানি ও রান্নার তেলসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যে স্বল্পতা ছিল, সেটা এখন নেই। মূল্যস্ফীতির হার অনেকটাই কমেছে। এই সবকিছুই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের অংশ। বাস্তবতা হলো, পরিস্থিতি গত বছর যতটা খারাপ ছিল, এ বছর ততটা নয়।

শ্রীলঙ্কার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাক্রোইকোন রিস্ক অ্যান্ড ফ্রন্টিয়ার রিসার্চের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ঝুঁকি বিভাগের প্রধান ছায়ু দামাসিংহে

আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, শ্রীলঙ্কা সরকার ব্যয় কমিয়ে রাজস্ব বাড়িয়েছে আর সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করে করজাল বিস্তৃত করেছে—মূলত এই দুটি নীতি পদক্ষেপের কারণে ঘুরতে শুরু করেছে দেশটির অর্থনীতির চাকা। তবে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, দেশটিকে এখনো লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে।

এ বিষয়ে শ্রীলঙ্কার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাক্রোইকোন রিস্ক অ্যান্ড ফ্রন্টিয়ার রিসার্চের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ঝুঁকি বিভাগের প্রধান ছায়ু দামাসিংহে বলেন, গত বছর জ্বালানি ও রান্নার তেলসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যে স্বল্পতা ছিল, সেটা এখন নেই। মূল্যস্ফীতির হার অনেকটাই কমেছে। এই সবকিছুই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের অংশ। বাস্তবতা হলো, পরিস্থিতি গত বছর যতটা খারাপ ছিল, এ বছর ততটা নয়।

নতুন গভর্নর আসার পর সরকার তাঁকে স্বাধীনভাবে দুটি কাজ করার সুযোগ দেয়। মূলত যে দুটি খাতে তিনি হাত দেন তাহলো, নীতি সুদহার বৃদ্ধি ও মুদ্রার একক বিনিময় হার নিশ্চিত করা। অন্যান্য দেশের মতো শ্রীলঙ্কায়ও মুদ্রার অনানুষ্ঠানিক বাজার আছে, সেখানকার কারসাজির কারণেও মুদ্রার বিনিময় হারে প্রভাব পড়ে, মূল্যস্ফীতি বাড়ে।

শ্রীলঙ্কা  ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক দুর্দশার মুখে পড়েছে। কয়েক মাস ধরে খাবার, জ্বালানি ও ওষুধের তীব্র সংকট চলছে
শ্রীলঙ্কা ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক দুর্দশার মুখে পড়েছে। কয়েক মাস ধরে খাবার, জ্বালানি ও ওষুধের তীব্র সংকট চলছেরয়টার্স ফাইল ছবি

আরেকটি বিষয় হলো, যে কারণে গত বছর এ রকম সংকট হলো, সেটা আমলে নেওয়া। সংকটের মূল কারণ ছিল বাজেট ও বহিঃস্থ অর্থনীতির ঘাটতি, যে কারণে ঋণসংকট তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। ঋণসংকট মোকাবিলায় এই দুই প্রতিষ্ঠান ঋণ পুনর্গঠন করছে। এ ছাড়া সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে নতুন কর আইন করাসহ করহার বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং ব্যয় সংকোচন করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

আইএমএফের শর্ত মেনে শ্রীলঙ্কার ঋণ পুনর্গঠনের চেষ্টা

চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কী করা হয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে ছায়ু দামাসিংহে বলেন, মূল্যস্ফীতির একটি কারণ ছিল দেশ থেকে অর্থ বেরিয়ে যাওয়া। সেটা হতো মূলত আমদানির মাধ্যমে, যার মূল্য পরিশোধ করতে হতো ডলারে। ডলার বেরিয়ে গেলে স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় মূল্য কমে যায়, যে কারণে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে।

২০২২ সালে দেশটির ৩ লাখ ১১ হাজারের বেশি মানুষ কাজের জন্য বিদেশে গেছেন, যাঁদের মধ্যে চিকিৎসক, প্যারামেডিকেল, তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের মতো অনেক উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী আছেন।

নতুন গভর্নর আসার পর সরকার তাঁকে স্বাধীনভাবে দুটি কাজ করার সুযোগ দেয়। মূলত যে দুটি খাতে তিনি হাত দেন তাহলো, নীতি সুদহার বৃদ্ধি ও মুদ্রার একক বিনিময় হার নিশ্চিত করা। অন্যান্য দেশের মতো শ্রীলঙ্কায়ও মুদ্রার অনানুষ্ঠানিক বাজার আছে, সেখানকার কারসাজির কারণেও মুদ্রার বিনিময় হারে প্রভাব পড়ে, মূল্যস্ফীতি বাড়ে। তবে মুদ্রার বিনিময় হারের ওঠানামা করলেও নীতি সুদহার বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরা গেছে।

শ্রীলঙ্কার সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের জুলাই মাসে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। এ সময়ে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি কমেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে সংকটের চূড়ান্ত সময়ে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৪৯ শতাংশের বেশি।

আরেকটি খাতে শ্রীলঙ্কা গত এক বছরে অনেক ভালো করেছে। সেটা হলো শ্রমশক্তি রপ্তানি। বস্তুত গত বছর বিদেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে দেশটি। ২০২২ সালে দেশটির ৩ লাখ ১১ হাজারের বেশি মানুষ কাজের জন্য বিদেশে গেছেন, যাঁদের মধ্যে চিকিৎসক, প্যারামেডিকেল, তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের মতো অনেক উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী আছেন। এঁরা বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় পাঠানোর কারণে গত এক বছরে দেশটির প্রবাসী আয় ৭৬ শতাংশ বেড়েছে।

তবে আইএমএফের ঋণের সঙ্গে নানা ধরনের শর্ত থাকে। এসব শর্ত পূরণ করা সাপেক্ষেই ঋণ দেওয়া হয়। এতে অনেক দেশ উপকৃত হয়, আবার অনেক দেশ বিপদে পড়ে। তবে শ্রীলঙ্কা এবার আইএমএফের ঋণের বেশির ভাগ শর্ত ভালোভাবেই পূরণ করতে পেরেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।