১০:৫৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘আব্বা, কান্না করিও না’

ডেঙ্গু আক্রান্ত ছেলে চট্টগ্রাম নগরের একটি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন। বাবা আবু মোহাম্মদ রায়হান চৌধুরীর মন মানছিল না। আরও উন্নত সেবার জন্য তিনি ছেলেকে নগরের অ্যাপোলো ইম্পেরিয়াল হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইছিলেন। কিন্তু হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিতে সময় লাগছিল। দেরি দেখে ছেলের সামনেই অসহায়ের মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা। তখন ছেলে সাফাত তাঁকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বলে ওঠে, ‘আব্বা, কান্না করিও না।’

সাফাতের এই শেষ কথাগুলোই এখন বাবার কানে বাজছে। সেদিন নগরের পাঁচলাইশের ওই হাসপাতাল থেকে জাকির হোসেন সড়কের ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল পর্যন্ত সারা পথে বাবার নির্ভরতার হাতটি ধরে ছিল আট বছরের আবু মোহাম্মদ সাফাত চৌধুরী। আর কোনো কথা হয়নি ছেলের সঙ্গে রায়হান চৌধুরীর। গত সোমবার ইম্পেরিয়াল হাসপাতালের চিকিৎসাধীন অবস্থায় পৃথিবীকে বিদায় জানায় তাঁর আদরের সাফাত।

ব্যবসায়ী রায়হান চৌধুরী নগরের দেওয়ানবাজার সাব-এরিয়া এলাকায় থাকেন। এক ছেলে এক মেয়ে। দুজনেই জামালখানের ওয়ালি উল্লাহ ইনস্টিটিউটে পড়ে। বড় বোনটি ষষ্ঠ শ্রেণিতে। সাফাত দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত। খুব বিজ্ঞানমনস্ক ছিল সাফাত। তথ্যটি দিয়েছেন তাঁর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবু সোলায়মান।

‘ছেলেটি অনেক ক্রিয়েটিভ (সৃজনশীল) ছিল। নিজে নিজে রোবট বানানোর চেষ্টা করত। বিজ্ঞানের আরও অনেক কিছু করতে চাইত। এত কম সময়ে চলে যাওয়া মানা যায় না,’ বললেন সোলায়মান।

বাবা রায়হান চৌধুরী ছিলেন তার এই সৃজনশীলতার নির্ভরতা। তিনি এখন ফটিকছড়ির গ্রামের বাড়িতে। সেখানেই মাটিতে শুইয়ে দেওয়া হয় ছেলেকে। ফোনের ওপার থেকে খুব কম কথায় ছেলের শেষ সময়ের স্মৃতিচারণা করছিলেন রায়হান চৌধুরী। বোঝা যাচ্ছিল, নিজেকে খুব শক্ত রাখার চেষ্টা করছেন তিনি। বেশি কথা বলতে গেলে যদি আবেগের বাঁধ ভেঙে যায়!

রায়হান বলেন, ‘আমার ছেলেটি টিভি দেখত না। কার্টুন দেখত না। গান শুনত না। ইউটিউবে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিভিন্ন ভিডিও দেখত। ট্রানজিস্টর বানাত, সার্কিট, বোর্ড এসব বানাত। আমাকে অর্ডার দিত জিনিস কিনে আনতে। আমি আইস ফ্যাক্টরি রোডের ইলেকট্রনিক মার্কেট থেকে কিনে এনে দিতাম।’

রোগশোক নিয়ে খুবই সচেতন ছিলেন রায়হান চৌধুরী। কারও জ্বর হলেই আগেভাগে পরীক্ষা করে ফেলেন। এবারও দু-এক দিন জ্বরের পর ২ সেপ্টেম্বর সাফাতের পরীক্ষা করান। রোগনির্ণয় কেন্দ্রের অনলাইনে ডেঙ্গু পজিটিভ দেখার পরই এক ব্যক্তিগত চিকিৎসকের পরামর্শে রায়হান ছেলেকে নগরের পাঁচলাইশের একটি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করান। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ইম্পেরিয়ালে নিয়ে যাচ্ছিলেন।

রায়হান বলেন, ‘আমি ওখানকার চিকিৎসায় সন্তুষ্ট ছিলাম না। তাই রোববার ইম্পেরিয়ালে নিয়ে যেতে তাড়াহুড়া করছিলাম। কিন্তু তাদের ফাইলপত্র দিতে দেরি হচ্ছিল। তখন আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি আইসিইউর ভেতরেই। তখনই ছেলেটা আমাকে সান্ত্বনা দেয়। আর কোনো কথা হয়নি। ছেলেটা আমাকে সময় দিল না। খুব তাড়াতাড়ি চলে গেল।’

তারপর পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু ‘ছেলের লাশ’ নিয়ে ফটিকছড়ির গ্রামের বাড়িতে আসেন রায়হান। সাফাতের মা-বোনের কান্না আর থামে না। স্কুলে যাওয়ার সময় আর কখনো বোন আফরার সঙ্গী হবে না সাফাত।

বিষয়

‘আব্বা, কান্না করিও না’

প্রকাশিত: ০২:৪৪:০৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩

ডেঙ্গু আক্রান্ত ছেলে চট্টগ্রাম নগরের একটি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন। বাবা আবু মোহাম্মদ রায়হান চৌধুরীর মন মানছিল না। আরও উন্নত সেবার জন্য তিনি ছেলেকে নগরের অ্যাপোলো ইম্পেরিয়াল হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইছিলেন। কিন্তু হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিতে সময় লাগছিল। দেরি দেখে ছেলের সামনেই অসহায়ের মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা। তখন ছেলে সাফাত তাঁকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বলে ওঠে, ‘আব্বা, কান্না করিও না।’

সাফাতের এই শেষ কথাগুলোই এখন বাবার কানে বাজছে। সেদিন নগরের পাঁচলাইশের ওই হাসপাতাল থেকে জাকির হোসেন সড়কের ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল পর্যন্ত সারা পথে বাবার নির্ভরতার হাতটি ধরে ছিল আট বছরের আবু মোহাম্মদ সাফাত চৌধুরী। আর কোনো কথা হয়নি ছেলের সঙ্গে রায়হান চৌধুরীর। গত সোমবার ইম্পেরিয়াল হাসপাতালের চিকিৎসাধীন অবস্থায় পৃথিবীকে বিদায় জানায় তাঁর আদরের সাফাত।

ব্যবসায়ী রায়হান চৌধুরী নগরের দেওয়ানবাজার সাব-এরিয়া এলাকায় থাকেন। এক ছেলে এক মেয়ে। দুজনেই জামালখানের ওয়ালি উল্লাহ ইনস্টিটিউটে পড়ে। বড় বোনটি ষষ্ঠ শ্রেণিতে। সাফাত দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত। খুব বিজ্ঞানমনস্ক ছিল সাফাত। তথ্যটি দিয়েছেন তাঁর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবু সোলায়মান।

‘ছেলেটি অনেক ক্রিয়েটিভ (সৃজনশীল) ছিল। নিজে নিজে রোবট বানানোর চেষ্টা করত। বিজ্ঞানের আরও অনেক কিছু করতে চাইত। এত কম সময়ে চলে যাওয়া মানা যায় না,’ বললেন সোলায়মান।

বাবা রায়হান চৌধুরী ছিলেন তার এই সৃজনশীলতার নির্ভরতা। তিনি এখন ফটিকছড়ির গ্রামের বাড়িতে। সেখানেই মাটিতে শুইয়ে দেওয়া হয় ছেলেকে। ফোনের ওপার থেকে খুব কম কথায় ছেলের শেষ সময়ের স্মৃতিচারণা করছিলেন রায়হান চৌধুরী। বোঝা যাচ্ছিল, নিজেকে খুব শক্ত রাখার চেষ্টা করছেন তিনি। বেশি কথা বলতে গেলে যদি আবেগের বাঁধ ভেঙে যায়!

রায়হান বলেন, ‘আমার ছেলেটি টিভি দেখত না। কার্টুন দেখত না। গান শুনত না। ইউটিউবে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিভিন্ন ভিডিও দেখত। ট্রানজিস্টর বানাত, সার্কিট, বোর্ড এসব বানাত। আমাকে অর্ডার দিত জিনিস কিনে আনতে। আমি আইস ফ্যাক্টরি রোডের ইলেকট্রনিক মার্কেট থেকে কিনে এনে দিতাম।’

রোগশোক নিয়ে খুবই সচেতন ছিলেন রায়হান চৌধুরী। কারও জ্বর হলেই আগেভাগে পরীক্ষা করে ফেলেন। এবারও দু-এক দিন জ্বরের পর ২ সেপ্টেম্বর সাফাতের পরীক্ষা করান। রোগনির্ণয় কেন্দ্রের অনলাইনে ডেঙ্গু পজিটিভ দেখার পরই এক ব্যক্তিগত চিকিৎসকের পরামর্শে রায়হান ছেলেকে নগরের পাঁচলাইশের একটি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করান। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ইম্পেরিয়ালে নিয়ে যাচ্ছিলেন।

রায়হান বলেন, ‘আমি ওখানকার চিকিৎসায় সন্তুষ্ট ছিলাম না। তাই রোববার ইম্পেরিয়ালে নিয়ে যেতে তাড়াহুড়া করছিলাম। কিন্তু তাদের ফাইলপত্র দিতে দেরি হচ্ছিল। তখন আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি আইসিইউর ভেতরেই। তখনই ছেলেটা আমাকে সান্ত্বনা দেয়। আর কোনো কথা হয়নি। ছেলেটা আমাকে সময় দিল না। খুব তাড়াতাড়ি চলে গেল।’

তারপর পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু ‘ছেলের লাশ’ নিয়ে ফটিকছড়ির গ্রামের বাড়িতে আসেন রায়হান। সাফাতের মা-বোনের কান্না আর থামে না। স্কুলে যাওয়ার সময় আর কখনো বোন আফরার সঙ্গী হবে না সাফাত।