‘হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা বেড়েছে। রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে। তবে চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়েনি। পর্যাপ্তসংখ্যক চিকিৎসক সেই। ফলে এই হাসপাতালে এসে মা কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না।’
মাগুরার শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসাসেবার করুণ অবস্থা নিয়ে সম্প্রতি এসব কথা বলেন দারিয়াপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জাকির হোসেন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কাছেই তাঁর বাড়ি। সাবেক এই জনপ্রতিনিধি বলেন, ‘হাসপাতাল আগের তুলনায় এখন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। যে পরিমাণ জনবল থাকার কথা, তা থাকলে এখানকার মানুষের আর মাগুরা বা ফরিদপুর ছুটতে হতো না।’
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৮ সালে দারিয়াপুর ইউনিয়নে তিন একর জমির ওপর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে। ২০১৭ সালের ২১ মার্চ এটিকে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। এর অংশ হিসেবে ৫০ শয্যার প্রশাসনিক অনুমোদন ও নতুন ভবন হয়েছে। তবে এরপর ছয় বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও জনবলকাঠামো অনুমোদন হয়নি। ফলে নামে ৫০ শয্যা হলেও এই হাসপাতাল এখনো চলছে ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের জনবলকাঠামো অনুযায়ী।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের জনবলকাঠামো অনুযায়ী চিকিৎসকের ১০টি পদ রয়েছে। এর মধ্যে সাতজন কর্মরত আছেন আর তিনটি পদ শূন্য। এগুলো হচ্ছে কনিষ্ঠ বিশেষজ্ঞ (অ্যানেসথেসিয়া ও গাইনি) এবং একজন সহকারী ডেন্টাল সার্জন। অবেদনবিদ না থাকায় গত দুই মাসে হাসপাতালে কোনো অস্ত্রোপচার হয়নি। অথচ চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে হাসপাতালে প্রসূতি অস্ত্রোপচারসহ প্রায় ৯০টি অস্ত্রোপচার হয়েছে।
৩১ শয্যার জনবলকাঠামো অনুযায়ী এখানে কনিষ্ঠ বিশেষজ্ঞের তিনটি পদ (মেডিসিন, গাইনি, অ্যানেসথেসিয়া) থাকার কথা থাকলেও এখানে শুধু মেডিসিন বিশেষজ্ঞ কর্মরত আছেন।
৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে জনবলকাঠামো অনুযায়ী এখানে কনিষ্ঠ বিশেষজ্ঞ (সার্জারি, কার্ডিওলজি, শিশু, চক্ষু, চর্ম ও যৌনরোগ, নাক, কান, গলা (ইএনটি), অ্যানেসথেসিয়া, গাইনি) নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তাই এই হাসপাতালে সব ধরনের রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না। অনেক সময় হৃদ্রোগী, চক্ষু এবং চর্ম ও যৌনরোগে আক্রান্ত রোগীরা এখানে এলে তাঁদের মাগুরা সদরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে দারিয়াপুর গ্রামের মাসুম কামাল বলেন, ‘হাসপাতালে ডাক্তারের চরম সংকট। বেশির ভাগ রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডাক্তার পাওয়া যায় না। রোগী এলেই বলে মাগুরা নিয়ে যান।’
গত ২৯ আগস্ট শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বেলা ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত অবস্থান করে দেখা যায়, অন্তর্বিভাগে প্রতিটি কক্ষে নির্ধারিত বিছানার চেয়ে অতিরিক্ত রোগী ভর্তি রয়েছেন। আর বহির্বিভাগে চিকিৎসকদের কক্ষের সামনে রোগীদের সারি।
গত ২৯ আগস্ট দুর্গাপুর গ্রাম থেকে অসুস্থ বাবা ও মাকে নিয়ে হাসপাতালের বহির্বিভাগে আসেন সাবিবুর রহমান। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ওই তরুণ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক ঘণ্টার বেশি সময় ১৪ নম্বর কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। চিকিৎসক দেখাতে পারিনি এখনো। আর জরুরি বিভাগে চিকিৎসক তো দেখতেই চাননি। আমরা স্থানীয়। আমাদেরই যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে দূর থেকে আসা রোগীদের সঙ্গে কী হয়?’ চিকিৎসকেরা জানান, হাসপাতালে প্রতিদিন অন্তর্বিভাগে গড়ে ৫০ জনের বেশি এবং বহির্বিভাগে ২০০ থেকে ২৫০ জন রোগী সেবা নিতে আসেন। এসব রোগীকে সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় চিকিৎসক ও কর্মচারীদের।
হাসপাতালে ডিজিটাল এক্স-রে ও আলট্রাসনোগ্রাম যন্ত্র না থাকায় রোগীদের বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত টাকা খরচ করে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হয়। কখনো কখনো তাঁদের জেলা সদরেও যেতে হয়।
জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আশরাফুজ্জামান লিটন প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাসপাতালে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ মানুষ আসা-যাওয়া করেন। ফলে এখানে পরিষ্কার রাখতে হলে পাঁচ-ছয়বার ঝাড়ু দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু জনবলের ঘাটতি থাকলে তো তা সম্ভব হয় না। এরপরও আমরা চেষ্টা করছি রোগীদের কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়ার।’ তিনি আরও বলেন, আবাসিক ভবনগুলো বসবাসের উপযোগী নয়। সেগুলো অপসারণের জন্য শিগগিরই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠাবেন তিনি।