০৮:১৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

সিলেটে পানিবন্দি ৩ লাখ মানুষ

ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সিলেটে বৃষ্টি ও উজানের ঢলে পানিতে টইটম্বুর সিলেটের সুরমা, কুশিয়ারা ও সারিগোয়াইন নদী। অথৈই জলে ফুলে-ফেঁপে ভয়ংকর রুপ ধারণ করেছে এই তিন নদী। নদীগুলোর বিভিন্ন পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। গত মঙ্গলবার থেকে নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও পরদিন বুধবার থেকে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে আরও দ্রুত পানি বাড়তে থাকে। এতে সিলেটের চার উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি আরও অনতি হতে থাকে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি গ্রাম পানির নীচে তলিয়ে গেছে। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা গোয়াইনঘাট, জকিগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও কোম্পানীগঞ্জে। এসব উপজেলার তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

সরেজমিনে বৃহস্পতিবার সকালে জৈন্তাপুর উপজেলার বিরাইমারা এলাকায় গেলে দেখা যায়, সিলেট-তামাবিল মহাসড়কের জৈন্তাপুরে রাস্তার পাশে একটি ট্রাকে শামিয়ানা টাঙানো। ওই ট্রাকে অবস্থান করছিলেন নারীশিশুসহ ১৫ জন। ট্রাকের নিচে বাধা পাঁচটি ছাগল। পাশে বাঁধা রয়েছে একটি গরু। এই ট্রাকে গতকাল বুধবার রাতে আশ্রয় নেন বিরাইমারা গ্রামের ওয়াহিদ মিয়া (৫৫)। তিনি বলেন, ট্রাকে এখন পর্যন্ত তাঁরা চার পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে ঘরে পানি উঠতে শুরু করেছিল। এরপর ভোর চারটার দিকে ঘরে আর থাকা যাচ্ছিল না। পরে গরু-ছাগলসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এই ট্রাক অবস্থান নেন। এরপর আরও তিনটি পরিবার তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেটের গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ ও জকিগঞ্জ উপজেলায় প্রায় তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। অধিকাংশের বাড়ি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এমনকি সিলেট-তামাবিল মহাসড়কও পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ফলে ওই এলাকায় সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে পানি বাড়তে শুরু করায় মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। হঠাৎ পানি বাড়ার কারণে নৌকার অভাবে অনেকে বাড়ি থেকে বের হতে পারেননি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বাঁচার আকুতি জানিয়ে পোস্ট দেন পানিবন্দি অনেকে। ‘লাশ উদ্ধার অইমু হয়তো,, জীবিত উদ্ধার অইতে পারতাম না,,, হয়তো এইটা শেষ পোস্ট।’ জৈন্তাপুর উপজেলায় ফেরিঘাট এলাকার সাজিদুর রহমান সাজন নামে এক যুবক বন্যার পানিতে আটকা পড়ে বুধবার রাতে ফেসবুকে এই পোস্ট দেন। সাজিদুরের মতো আরও কয়েকজন নৌকা চেয়ে পোস্ট দেন। ময়নাহাটি খেয়াঘাট এলাকার আহমেদ নাইম ফেসবুকে পোস্টে লেখেন ‘একটা ইঞ্জিন নৌকার দরকার, কেউ বাঁচাও আমরারে।’ পরে স্থানীয়রা এসব বাড়ি থেকে মানুষকে উদ্ধার করেন।

বন্যা পূর্বাভাসস ও সতর্ককীরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় সিলেটের সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে ১৪ দশমিক ১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যা বিপৎসীমার ২ দশমিক ৬ পয়েন্ট ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেটের সারিগোয়াইনঘাট নদী সারিঘাট পয়েন্টে ১১ দশমিক ২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যা বিপৎসীমার ১ দশমিক ৬৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে সিলেটের কুশিয়ারা নদী আমলশীদ পয়েন্টে ১৪ দশমিক ৪২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যা বিপৎসীমার ২ দশমিক ৪৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়াও লোভা, ডাউকি, সারি-গোয়াইন, ধলাইসহ সব কটি নদ-নদীর পানি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এদিকে, সুরমা-কুশিয়ারা নদীর অন্তত ১৫ স্থানে নদী প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে প্রবল বেগে পানি ঢুকছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে অন্তত দুই কিলোমিটার এলাকা নদীর পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। এতে করে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।

সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবারক হোসেন খোলা কাগজকে বলেন, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা সকল ধরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। সিলেটের পাঁচটি উপজেলায় ২১৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে গোয়াইনঘাটে ৫৬, জৈন্তাপুরে ৪৮, কানাইঘাটে ১৮, কোম্পানীগঞ্জে ৩৫ ও জকিগঞ্জে ৫৮টি। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষজন উঠতে শুরু করেছেন। এছাড়া জেলা প্রশাসন থেকে ২০০ বস্তা করে মোট ১ হাজার বস্তা শুকনো খাবার, ৭৫ মেট্রিক টন চাল, আড়াই লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে বরাদ্দ আরও বাড়ানো হবে।

সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. মনিসর চৌধুরী খোলা কাগজকে বলেন, আমরা দেড় লাখ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট মজুদ রেখেছি। বন্যার সময় সাপের উপদ্রব বাড়ে। এই কারণে ২২০ ভায়েল এন্টিভ্যানম প্রস্তত রয়েছে। পাশাপাশি বন্যার পরে ডায়রিয়া ও কলোর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। যার কারণে কলেরা স্যালাইন পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। এছাড়া ১৩১টি মেডিকেল টিম কাজ করবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী শহিদুজ্জামান সরকার বলেন, মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জিতে গত ২৪ ঘন্টায় ৬৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। যার কারণে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর ফুঁসে উঠার প্রবণতা কমছে না। ওই এলাকার বৃষ্টি না কমলে সিলেটে বন্যার পানি কমবে না।

বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

সিলেটে পানিবন্দি ৩ লাখ মানুষ

প্রকাশিত: ০৬:২৪:০১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ মে ২০২৪

ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সিলেটে বৃষ্টি ও উজানের ঢলে পানিতে টইটম্বুর সিলেটের সুরমা, কুশিয়ারা ও সারিগোয়াইন নদী। অথৈই জলে ফুলে-ফেঁপে ভয়ংকর রুপ ধারণ করেছে এই তিন নদী। নদীগুলোর বিভিন্ন পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। গত মঙ্গলবার থেকে নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও পরদিন বুধবার থেকে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে আরও দ্রুত পানি বাড়তে থাকে। এতে সিলেটের চার উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি আরও অনতি হতে থাকে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি গ্রাম পানির নীচে তলিয়ে গেছে। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা গোয়াইনঘাট, জকিগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও কোম্পানীগঞ্জে। এসব উপজেলার তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

সরেজমিনে বৃহস্পতিবার সকালে জৈন্তাপুর উপজেলার বিরাইমারা এলাকায় গেলে দেখা যায়, সিলেট-তামাবিল মহাসড়কের জৈন্তাপুরে রাস্তার পাশে একটি ট্রাকে শামিয়ানা টাঙানো। ওই ট্রাকে অবস্থান করছিলেন নারীশিশুসহ ১৫ জন। ট্রাকের নিচে বাধা পাঁচটি ছাগল। পাশে বাঁধা রয়েছে একটি গরু। এই ট্রাকে গতকাল বুধবার রাতে আশ্রয় নেন বিরাইমারা গ্রামের ওয়াহিদ মিয়া (৫৫)। তিনি বলেন, ট্রাকে এখন পর্যন্ত তাঁরা চার পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে ঘরে পানি উঠতে শুরু করেছিল। এরপর ভোর চারটার দিকে ঘরে আর থাকা যাচ্ছিল না। পরে গরু-ছাগলসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এই ট্রাক অবস্থান নেন। এরপর আরও তিনটি পরিবার তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেটের গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ ও জকিগঞ্জ উপজেলায় প্রায় তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। অধিকাংশের বাড়ি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এমনকি সিলেট-তামাবিল মহাসড়কও পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ফলে ওই এলাকায় সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে পানি বাড়তে শুরু করায় মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। হঠাৎ পানি বাড়ার কারণে নৌকার অভাবে অনেকে বাড়ি থেকে বের হতে পারেননি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বাঁচার আকুতি জানিয়ে পোস্ট দেন পানিবন্দি অনেকে। ‘লাশ উদ্ধার অইমু হয়তো,, জীবিত উদ্ধার অইতে পারতাম না,,, হয়তো এইটা শেষ পোস্ট।’ জৈন্তাপুর উপজেলায় ফেরিঘাট এলাকার সাজিদুর রহমান সাজন নামে এক যুবক বন্যার পানিতে আটকা পড়ে বুধবার রাতে ফেসবুকে এই পোস্ট দেন। সাজিদুরের মতো আরও কয়েকজন নৌকা চেয়ে পোস্ট দেন। ময়নাহাটি খেয়াঘাট এলাকার আহমেদ নাইম ফেসবুকে পোস্টে লেখেন ‘একটা ইঞ্জিন নৌকার দরকার, কেউ বাঁচাও আমরারে।’ পরে স্থানীয়রা এসব বাড়ি থেকে মানুষকে উদ্ধার করেন।

বন্যা পূর্বাভাসস ও সতর্ককীরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় সিলেটের সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে ১৪ দশমিক ১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যা বিপৎসীমার ২ দশমিক ৬ পয়েন্ট ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেটের সারিগোয়াইনঘাট নদী সারিঘাট পয়েন্টে ১১ দশমিক ২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যা বিপৎসীমার ১ দশমিক ৬৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে সিলেটের কুশিয়ারা নদী আমলশীদ পয়েন্টে ১৪ দশমিক ৪২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যা বিপৎসীমার ২ দশমিক ৪৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়াও লোভা, ডাউকি, সারি-গোয়াইন, ধলাইসহ সব কটি নদ-নদীর পানি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এদিকে, সুরমা-কুশিয়ারা নদীর অন্তত ১৫ স্থানে নদী প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে প্রবল বেগে পানি ঢুকছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে অন্তত দুই কিলোমিটার এলাকা নদীর পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। এতে করে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।

সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবারক হোসেন খোলা কাগজকে বলেন, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা সকল ধরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। সিলেটের পাঁচটি উপজেলায় ২১৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে গোয়াইনঘাটে ৫৬, জৈন্তাপুরে ৪৮, কানাইঘাটে ১৮, কোম্পানীগঞ্জে ৩৫ ও জকিগঞ্জে ৫৮টি। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষজন উঠতে শুরু করেছেন। এছাড়া জেলা প্রশাসন থেকে ২০০ বস্তা করে মোট ১ হাজার বস্তা শুকনো খাবার, ৭৫ মেট্রিক টন চাল, আড়াই লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে বরাদ্দ আরও বাড়ানো হবে।

সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. মনিসর চৌধুরী খোলা কাগজকে বলেন, আমরা দেড় লাখ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট মজুদ রেখেছি। বন্যার সময় সাপের উপদ্রব বাড়ে। এই কারণে ২২০ ভায়েল এন্টিভ্যানম প্রস্তত রয়েছে। পাশাপাশি বন্যার পরে ডায়রিয়া ও কলোর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। যার কারণে কলেরা স্যালাইন পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। এছাড়া ১৩১টি মেডিকেল টিম কাজ করবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী শহিদুজ্জামান সরকার বলেন, মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জিতে গত ২৪ ঘন্টায় ৬৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। যার কারণে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর ফুঁসে উঠার প্রবণতা কমছে না। ওই এলাকার বৃষ্টি না কমলে সিলেটে বন্যার পানি কমবে না।