সদ্য পেরিয়ে আসা চৈত্রের দাবদাহে দেশের চার বিভাগে জারি হয়েছিল সতর্কবার্তা। বৈশাখের কেবল তিনটি দিন পেরিয়েছে। অর্থাৎ ‘গরমের’ দিন পড়েই রয়েছে। দীর্ঘ গরমে সুস্থ থাকতে সচেতনতার বিকল্প নেই। বিশেষ করে পরিবারের শিশু এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি বাড়তি খেয়াল রাখতে হবে। জেনে নিন এই গরমে সুস্থ থাকার উপায়।
প্রচণ্ড উত্তাপে শরীর অবসন্ন হয়ে পড়ে। ঘামের মাধ্যমে শরীর থেকে প্রচুর পানি বেরিয়ে যায়। ফলে খুব সহজেই পানিশূন্যতা হয়। ঘামের সঙ্গে শরীর থেকে প্রয়োজনীয় লবণও বেরিয়ে যায়। পানি ও লবণের এই ঘাটতি দ্রুততম সময়ে পূরণ করে ফেলতে হবে। তবে প্রাণের তৃষ্ণা মেটাতে যেখানে-সেখানে ‘যা হোক একটা পানীয়’ খেয়ে নেওয়াও কিন্তু ঠিক না। নিরাপদ খাবার, আরামদায়ক পোশাক এবং নিয়মতান্ত্রিক শরীরচর্চা নিশ্চিত করলে সুস্থ থাকা সম্ভব।
পানি এবং লবণের ঘাটতি পূরণ
প্রচুর পানি খেতে হবে। পানি খাওয়ার বিষয়ে কিন্তু ধরাবাঁধা পরিমাণ নির্ধারণ করা যায় না। যতটা পানি শরীর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, তা পূরণ হওয়া চাই। দেহের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াগুলোকে সচল রাখতে পর্যাপ্ত পানি বা তরল খাবার রোজই খেতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, আপনি যাতে পানিশূন্য হয়ে না পড়েন। কেবল তৃষ্ণা পেলেই পানি খেতে হবে, তা কিন্তু নয়। বরং পানি বা তরল খাবার খেতে হবে বারবার। বিশেষ করে যখন আপনি বাইরে যাচ্ছেন, শারীরিক পরিশ্রম করছেন কিংবা চুলার আঁচে কাজ করছেন, সেই সময় বারবার তরল খাবার গ্রহণ করুন। খেয়াল রাখুন, মুখের ভেতরটা যাতে শুষ্ক হয়ে না পড়ে। প্রস্রাব করার সময় প্রস্রাবের রং এবং পরিমাণ লক্ষ করুন; গাঢ় হলুদ রং দেখলে কিংবা পরিমাণে কম হলে বুঝতে হবে, আপনি পানিশূন্যতায় ভুগছেন। বেশি ঘাম হলে ওরস্যালাইন বা সামান্য লবণ দেওয়া পানীয় খান।
নিরাপদ খাবার এবং পানীয়
পথের ধারের পানীয় গ্রহণ করবেন না। বরং নিজের সঙ্গেই পানি রাখুন। তবে প্লাস্টিকের কোনো বোতল বা পাত্রে পানি বা পানীয় রাখবেন না। কাচ বা ধাতব উপকরণের পাত্র ব্যবহার করুন। একাধিক স্তরবিশিষ্ট ফ্লাস্কও বেছে নেওয়া যায় বলে জানালেন ডা. মো. মতলেবুর রহমান। সুস্থ থাকতে নিরাপদ পানি, পানীয় এবং খাবারের প্রতি জোর দিলেন এই চিকিৎসক। এভাবে হেপাটাইটিস, ডায়রিয়া, কলেরার মতো ব্যাধি প্রতিরোধ করা সম্ভব। খাবার এবং পানীয় প্রস্তুতকরণ এবং সংরক্ষণ করতে হবে সতর্কতার সঙ্গে। হাতের নখ ছোট রাখা, খাবার প্রস্তুতের আগে ও খাওয়ার সময় সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, তৈজসপত্র পরিষ্কার রাখা, খাবার ঢেকে রাখার মতো ‘সাধারণ’ বিষয়গুলো মেনে চলতে হবে অবশ্যই। তাহলে পেটের পীড়ার ঝুঁকি কমবে। খাবার দীর্ঘ সময় বাইরে ফেলে রাখা যাবে না। সময়মতো ফ্রিজে উঠিয়ে রাখতে হবে। তবে ভাতজাতীয় খাবার পুনরায় গরম করে খাওয়া ঠিক নয়।
কী খাবেন, কী খাবেন না
গরমের খাবারদাবার বিষয়ে আরও কিছু পরামর্শ দিলেন রাজধানীর গভর্নমেন্ট কলেজ অব অ্যাপ্লায়েড হিউম্যান সায়েন্সের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শম্পা শারমিন খান। গরমে হালকা মসলা, হালকা তেলে রান্না করা সহজপাচ্য খাবার খেতে হবে। মিশ্র সবজির ঝোল ঝোল রান্না, ডাল আর মাছের ঝোল খেতে পারেন। চর্বি খাবেন না। মাংস যদি খেতেই হয়, তাহলে ছোট বা মাঝারি আকারের দেশি মুরগি বেছে নিন। নইলে ব্রয়লার মুরগির বুকের মাংস রান্না করতে পারেন ছোট কিউব করে। অন্য অংশ এড়িয়ে চলুন। ডালের টক করতে পারেন। মুগ ডাল দিয়ে পেঁপে রাঁধতে পারেন। বুটের ডালের তরকারি কিংবা বিভিন্ন রকম শাকও খেতে পারবেন। ডিম ভাজি বা পোচের বদলে সেদ্ধ খান। পানিজাতীয় ফলমূল খেতে হবে। খোসাসহ ফল খাওয়া ভালো। লেবু ও কাঁচা সালাদ খান। ফলের রসও খেতে পারেন, তবে চিনি মেশানো যাবে না। চা-কফি এড়িয়ে চলতে পারলে ভালো। নিতান্তই যদি খেতে হয়, তাহলে রং চা পান করুন, এই চা কিন্তু ‘কোল্ড টি’ হিসেবে খেতে পারেন। কফি খেতে চাইলেও দুধ ছাড়া, ঠান্ডা কফি খেতে পারেন। ৯টার মধ্যেই রাতের খাবার সারুন। পরে খিদে পেলে হালকা ঠান্ডা দুধ খেতে পারেন, বিস্কুট বা কলাও খেতে পারেন। কোষ্টকাঠিন্য এড়াতে ইসবগুলের ভুসি খেতে পারেন রাতে, পানিতে মেশানোর সঙ্গে সঙ্গেই খেতে হবে।
এমন জায়গায় থাকুন, যেখানে বাতাস প্রবাহিত হয়। আরামদায়ক, সুতি পোশাক পরুন। আনকোরা পোশাকের চাইতে একটু বেশি দিন ব্যবহার করা পোশাক বেশি আরামদায়ক। বাইরে যাওয়ার আগে প্রস্তুতি নিন। রোদ এবং ধুলাবালু থেকে চুল বাঁচাতে স্কার্ফ ব্যবহার করতে পারেন। তা ছাড়া ঢিলেঢালা জামা এবং ফুলপ্যান্ট বা পায়জামা পরা ভালো। রোদে বের হলে সানগ্লাস পরুন। সানস্ক্রিন সামগ্রী ব্যবহার করুন, ত্বক ভালো থাকবে। বাইরে যাওয়ার আগে ছাতা নিতে ভুলবেন না। বাইরে লম্বা সময় কাটাতে হলে বাড়ি থেকেই খাবার নিয়ে যান। নিতান্তই সম্ভব না হলে প্যাকেটজাত খাবার খেতে পারেন, যা দ্রুত পচনশীল নয়। অবশ্যই চেষ্টা করুন ছায়াময় স্থানে থাকার। রোজ গোসল করুন। একাধিকবার গোসলেও ক্ষতি নেই। আরামাদায়ক পোশাক পরে শরীরচর্চাও করতে হবে নিয়মমাফিক।
শিশুর প্রতি যত্নশীল হোন
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিশু বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক মো. শাহেদুর রহমান জানালেন শিশুর যত্নের নানান দিক। শিশুদেরও পর্যাপ্ত পানি খাওয়াতে হবে। আরামদায়ক পোশাক পরিয়ে রাখুন। হাত পরিষ্কার রাখার নিয়ম শিখিয়ে দিন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিধি মেনে চলতে সাহায্য করুন। কেবল হাত ধোয়ার অভ্যাসেই পেটের পীড়া, সর্দি-কাশি এমনকি কনজাংটিভাইটিসের মতো রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাজা মৌসুমি ফলমূল খেতে দিন। শিশুদের ছায়ায় রাখুন। বাইরে নেবেন নরম রোদের বেলায়। রোজ একবার গোসল করিয়ে দিন, শিশুর উপযোগী সাবান ব্যবহার করুন। গোসলের আগে তেল আর পরে পাউডার লাগিয়ে দিতে পারেন। ঘামাচি হলে নরম সুতি কাপড় ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে ত্বক মুছে দিন। শিশুর চুল রাখুন আরামদায়ক মাপে। ঠান্ডা পানি বা আইসক্রিম খেতে বাধা নেই, যদি কোল্ড অ্যালার্জি না থাকে। তবে একেবারে তীব্র গরমের মধ্যে খুব ঠান্ডা কিছু খাওয়া ঠিক নয়।
লেখক: ডা. মো. মতলেবুর রহমান
-সহযোগী অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।